বিশেষ প্রতিনিধি::
মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উজানিগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ সংলগ্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধিসৌধ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইতিহাসবিদদের মতে এখানে মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিস্টান ধর্মের মৃত্যুঞ্জয়ী তিন মুক্তিযোদ্ধা পাশাপাশি শুয়ে আছেন ১৯৭১ সন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হিসেবে সমাধিটি যুদ্ধের পর থেকেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। সরকারিভাবে প্রতিটি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে তিন যোদ্ধাকেই শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। এখনো নিয়মিত জাতীয় দিবসগুলোতে সরকারিভাবে তিন যোদ্ধাকেই শ্রদ্ধা জানানো হয়ে থাকে।
সম্প্রতি স্থানীয় একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এই তিন যোদ্ধার বদলে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত স্মৃতি মুছে দিয়ে এক শহীদের নামে ‘গোপনে’ নামফলক লাগিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন মুক্তিযোদ্ধা জনতা। বিদ্যালয়ের অধীনস্থ এই সমাধিটিতে কে বা কারা এই ফলক লাগিয়েছে তা বলতে পারেননি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তবে জানা গেছে, স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী একটি গোষ্ঠীই অতিউৎসাহী হয়ে এই কাজটি করেছে। এ ঘটনায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দায়ি করেছেন।
জানা গেছে, গত মার্চ মাসে সিলেটে একটি অনুষ্ঠানে তিন শহীদের এই সমাধিটি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে সংস্কারের দাবি জানান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আল আজাদ। এই সময় শিক্ষামন্ত্রী সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে তিন শহীদের সমাধি সংস্কার ও তিনজনের নামে ফলক নির্মাণের নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর নির্দেশে সংশ্লিষ্টরা তিন শহীদের নামে প্রথমে ফলক নির্মাণে উদ্যোগ নিলেও স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও স্মৃতি মুছে দিতে দুই শহীদ (তাদের মতে বিধর্মী) বাদ দিয়ে কেবল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তালেবের নামে ফলক ও সংরক্ষণের তৎপরতা শুরু করে। এ নিয়ে গত ১০ মে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্দেশে বিদ্যালয়ে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সুনামগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন, সাংবাদিক আল-আজাদ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তালেব উদ্দিন আহমদের ভাই সিলেটের অতিরিক্ত পিপি শামসুল ইসলাম, জয়কলস-উজানীগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভাপতি মো. শাহজাহান মিয়া, সাংবাদিক শামস শামীম, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শচীন্দ্র চন্দ্র সরকার, পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. নুরুল আমিন, শিক্ষক এএলএম নজরুল ইসলাম, শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন, কবিতা রানী রায়, শঙ্করী চক্রবর্তী, মো. আলিমুল ইসলাম, মো. আবু ইসহাক, হীরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী, জলি রানী তালুকদার, মো. নজরুল ইসলাম, চম্পা রানী সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. মসকু মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় মুক্তিযোদ্ধা জানু মিয়ার ছেলে মসকু মিয়া এবং সাংবাদিক শামস শামীম এখানে তিন শহীদের সমাধি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের জানান। তারা এর পক্ষে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লিখিত তথ্যও উপস্থাপন করেন। কিন্তু ম্যানেজিং কমিটির স্বাধীনতা বিরোধী কয়েকজন প্রভাবশালী এখানে শুধু শহীদ তালেবের সমাধির কথা স্বীকার করে ফলক লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। গত ১৫ জুন সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা ম্যানেজিং কমিটির এই সিদ্ধান্তের ফলে ফলক লাগানোর জন্য শহীদ সমাধিস্থলে আসার প্রস্তুতি নেন। এই খবর পেয়ে সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। পরিষদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের নেতা ওবায়দুর রহমান কুবাদ ও পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাংবাদিক শামস শামীম ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সিলেট অঞ্চলের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর কবীর আহাম্মদকে এই অনুরোধ করেন। তারা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের অফিসে গিয়েও এ বিষয়ে কথা বললে সংশ্লিষ্টরা ফলক নির্মাণ থেকে সরে আসেন।
সম্প্রতি স্বাধীনতা বিরোধী ওই গোষ্ঠী গোপনে শহীদ কৃপেন্দ্র ও নাম না জানা অন্য ধর্মাবলম্বী আরেক শহীদকে বাদ দিয়ে কেবল শহীদ তালেবের নামে ফলক লাগিয়ে স্মৃতিসৌধটি সংস্কারও করে। ফলকে কেবল শহীদ তালেবের কথাই লেখা রয়েছে। অন্য দুই শহীদের বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়েছে। তবে ফলক কারা লাগিয়েছে সেটা উল্লেখ নেই।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার বিকেলে সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবু সুফিয়ান ও সাবেক সদস্য সচিব মালেক হুসেন পীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহে ওই এলাকায় যান। এসময় তারা শহীদ সমাধিতে গিয়ে অন্য দুই শহীদের নাম বাদ দিয়ে এক শহীদের নামফলক লাগানোর দৃশ্য দেখতে পান। সাথে সাথে তাঁরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কারা এই ফলক লাগিয়েছে তা বলতে পারেননি। এই খবরটি ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্মৃতি মুছে দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন।
মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, আমরা শহীদ স্মৃতিসৌধ সংস্কার ও তিন যোদ্ধার নামে নামফলক লাগানোর খবর পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। যখন জানতে পারি একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দুই যোদ্ধার ভিন্নধর্মের কারণে তাদের নাম মুছে ফেলতে চাচ্ছে তখন উদ্যোক্তাদের ইতিহাস বিকৃতি থেকে সরে আসার আহ্বান জানালে তারা আমাদের কথা শোনেন। কিন্তু গতকাল শহীদ সমাধিতে গিয়ে আমরা অবাক হয়েছি। কে বা কারা এক যোদ্ধার নামে ফলক লাগিয়ে দিয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে চাপা দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই যোদ্ধারা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শচীন্দ্র চন্দ্র সরকারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সনের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত হওয়ার আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আহসানমারা (হালে শহীদ তালেব সেতু) এলাকায় প্রাণ হারান মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তালেব আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা কৃপেন্দ্র দাস এবং নাম না জানা অন্য ধর্মের আরেক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তদিবসের পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা-জনতা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তিন শহীদের লাশ নদী থেকে উদ্ধার করে জয়কলস উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি স্থানে সমাহিত করেন। এরপর থেকেই বিরল এই সমাধিস্থানটি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।