জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া::
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর সীমান্তের টেকেরঘাটে অবস্থিত চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা সরকারী যন্ত্রপাতি খোলা আকাশের নিচে থেকে মরিচা পড়ে নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে প্রকল্পের যাবতীয় কার্যক্রম। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে খনিপ্রকল্পের পতিত ভূমি ও বাসা-বাড়ি দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। ইতিমধ্যে খনিজ প্রকল্পের প্রায় ২০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ গায়েব হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। স্থানীয় ভাংগারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে চোরাই পথে প্রতিদিন যন্ত্রপাতি পাচাঁর করা হচ্ছে ভারতে স্থানীয় এলাকাবাসীর এমন অভিযোগও আছে।
খনিপ্রকল্প ও স্থানীয় সূত্র জানায়,২০০৭ সালের ২ অক্টোবর ৩১ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে বদলীর মধ্য দিয়ে বেজে উঠেছিল প্রকল্পটির বিদায় ঘন্টা। এরপর খনিপ্রকল্প এলাকা রক্ষনাবেক্ষনের ১ জন কর্মকর্তা, ১ জন এপিসি, ১জন পিসি ও ১৮ জন আনসার সদস্য নিয়োগ করা হয়। তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে মিলে খনিপ্রকল্পের রাস্তাঘাট অবৈধ ভাবে লিজ দেওয়া থেকে শুরু করে পাহাড়ী টিলা কেটে কয়লার ডিপু নির্মাণ, পতিত জায়গা দখলসহ খনিজ প্রকল্পে ১৭টির বেশী চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ করে অনেকেই হয়েছেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। এছাড়া রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে খোলা আকাশের নীচে থেকে মরিচা পড়ে নষ্ট হচ্ছে আরো কোটি কোটি টাকার সম্পদ স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ।
সরজমিন এলাকা গুরে খোঁজ নিয়ে জানাযায়-দেশের সিমেন্টের চাহিদা পূরন করতে ১৯৪০ সালে ছাতকে সুরমা নদীর তীরে আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরী স্থাপন করা হয়। যা বর্তমানে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী নামে পরিচিত। তখন ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানী করে সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচা মালের চাহিদা পূরন করা হত। এরপর ১৯৬১ সালে ভূ-তত্ত্ব জরিপ চালিয়ে তাহিরপুর সীমান্তের ভাঙ্গারঘাট ও টেকেরঘাটে ৫টি কুপখনিতে প্রায় ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৫৬ হাজার ৫ শত ৩৪ মেঃ টন চুনাপাথর মজুদ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এরপরে ১৯৬৫ সালে টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্পের ৩শত ২৭একর জায়গার মধ্যে চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে ২টি কোয়ারী থেকে চুনাপাথার উত্তোলন করা হয়। কিন্তু অপরিকল্পিত ভাবে চুনাপাথর উত্তোলন করার কারণে কোয়ারীতে গভীরতা বেশী হওয়ায় মাত্র ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৭ শত ৮৩ মেঃটন পাথর উত্তোলন করে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বিসিআইসি চুনাপাথর উত্তোলন বন্দ করে দেয়। সেই সাথে ভারতীয় সীমান্তে বাঁধার মুখে ভাঙ্গারঘাট-লামাকাটা কোয়ারীর উৎপাদনও বন্দ হয়ে যায়। তারপর ১৯৮৪সালে বিসিআইসির বোর্ড সভায় টেকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পটি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর অন্তভূক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে চালু রাখার সিদ্বান্ত নেয়। ১৯৮৬সাল পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত রেখার ৩০ফুটের ভিতর থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের চুক্তির পর ১৯৮৭সালে ভারতীয় বিএসএফ একশ ৫০ গজ দুর থেকে পাথর উত্তোলন করার চাপ প্রয়োগ করে। ফলে ওই কোয়ারীগুলো আবারও বন্দ হয়ে যায়। চুনাপাথর উত্তোলনের কাচাঁমাল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের মধ্যে রয়েছে-৩টি ক্রেইন,৩কলোমিটার ন্যারোগ্যাজ রেল লাইন,২০লাখ টাকার সিøপারিং,৫কোটি টাকার মূল্যের ২টি জেনেরেটর,২কোটি টাকা মূল্যের লোকাল ট্রলি ইঞ্জিন,৫টি টিপিং টাব,বেকু হেলি,লোডার,ওয়ার্কসপ,ওয়েব্রিজসহ বিভিন্ন মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও স্থাপনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানান, প্রায় দুই যুগের বেশী সময় যাবত বন্ধ প্রকল্পের যাবতীয় কার্যক্রম। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে খনিপ্রকল্পের পতিত ভূমি ও বাসা-বাড়ি দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা মাসোহারা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আতাত করেই। ফলে তারা আঙ্গুল ফলে হয়েছে কলাগাছ। র্দীঘ দিন ধরে বেহাল ভাবে থাকায় প্রকল্পটি চালু করার দাবী জানান স্থানীয় বেকার হাজার হাজার যুবক ও শ্রমিকগন। জোর যার মুল্লুকতার এখানে পরিনত হয়েছে। যেন দেখার কেউ না।
ব্যবসায়ী সুমন দাস, শংকরসহ অনেকেই জানায়,এই উপজেলার ৩টি শুল্ক ষ্টেশন র্দীঘ দিন ধরে ভারতীয় পরিবেশবাদী সংঘটনের দায়ের কৃত মামলার কারনে বার বার বন্ধ হয় আবার কিছু দিন খোলা থাকার পর আবারও বন্ধ থাকে। এ কারনে প্রচুর চাহিদা থাকা ভারতীয় কয়লা আমদানী করতে না পারার ব্যবসায়ীরা মারাতœক ভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে আর বেকার হয়ে পড়েছে এর সাথে জড়িত হাজার হাজার দিনমজুর। চুনপিাথর খনিজ প্রকল্পটি চালু হলে বেকার সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হত। এছাড়ার পর্যটন সমৃদ্ধ এই উপজেলার সর্ব স্থরের সচেতন জনসাধারনের মাঝে তাহিরপুর উপজেলার এক সমাবেশে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্বের ঘোষিত প্রতিশ্রুতির বাস্থবায়নের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবী জানান সবাই।
সাদেক আলী, সবুজ মিয়া, সুমনসহ স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু সম্প্রতি তাহিরপুর উপজেলা ট্যাকেরঘাটে ৮ই সেপ্টেম্ভর শনিবার এসেছিলেন। র্দীঘ দিন ধরে বন্ধ চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পটি স্ব-চক্ষে দেখেছেন। কিন্তু আশানুরুপ কোন আশার বানী শুনতে পারি নি। এই বিষয়টি নিয়ে প্রধান মন্ত্রীর সাথে কথা বলে গুরুত্ব দিয়ে এর সমাধান করলে ও র্দীঘ দিন ধরে বন্ধ থাকা চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পটি চালুর বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে হাজার শ্রমিক কাজের সুযোগ হবে।
অবৈধ ভাবে যন্ত্রপাতি বিক্রি, মরিচা পড়ে নষ্ট ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় কিছু সংখ্যাক লোক খনি প্রকল্পের সম্পত্তি অবৈধ ভাবে দখল করে আছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির এমডি শ্যামলেন্দু দও বলেন-এই বিষয়ে আপনার যা প্রশ্ন তার উত্তর দেব। আপনি সরাসরি আমাদের অফিসে আসেন তার পর কথা বলেন। ফোনে বললে কি সমস্যা জানতে চাইলে তিনি ফোনে কথা বলতে পারব না বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ বলেন, খনি প্রকল্পের পতিত জায়গা-জমি ও অব্যবহৃত যন্ত্রাংশ কিভাবে রক্ষা করা যায় আর সরকারী সম্পদ রক্ষা করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নেয়া হবে। খনি প্রকল্পের প্রায় ৩শত একর জায়গা আছে। এই এলাকায় আমাদের একটি মাষ্টার প্লান রয়েছে সে আনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। শিল্পকারখানা তৈরী না করে জীববৈচিত ও টাংগুয়ার হাওরসহ এই এলাকার পর্যটনশিল্পের সম্ভবনাকে সামনে ধরে তা রক্ষার পাশা পাশি পর্যটন বান্ধব শিল্প পার্ক ও পরিবেশ তৈরী করা যায় কি না যা কক্সবাজারে তৈরী করা হয়েছে সে আলোকে প্রস্তবনা তৈরী করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে করে এখানে সবার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হবে।