বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সদস্য সচিব মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর দেশব্যাপী অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে নিজের সর্বস্ব খুইয়ে এখন প্রায় নিঃস্ব। প্রায়ই অসুখ-বিসুখে ভোগেন। স্বাভাবিক চিকিৎসাও করাতে পারেন না। তারপরও মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে সরে যাননি তিনি। অসুখ-বিসুখে ভোগেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অবশেষে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি সেখান থেকেই সুনামগঞ্জ পিটিআই বধ্যভূমিতে গড়ে ওঠা স্থাপনা অপসারণ করে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিবকে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
জানা গেছে, মালেক পীরের জনস্বার্থের এই লড়াইয়ে দুর্নীতিবাজ শীর্ষ আমলাদের অনেকেই জেল খেটেছেন। এখনো তিনি স্থানীয় অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এই মুক্তিযোদ্ধা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় অবস্থান করছেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. আব্দুল্লাহ আল হারুনের তত্ত্বাবধানে ডা. মামুন আল মাহতাবের অধীনে আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই গত ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি সুনামগঞ্জের আলোচিত গণহত্যাস্থল ও পিটিআই বধ্যভূমির মূল জায়গা উদ্ধারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন। অসুস্থ থেকেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান উদ্ধারের এই প্রচেষ্টায় লড়াকু এই যোদ্ধাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তার সহযোদ্ধারা। মালেক পীর বর্তমানে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানীয় ডাক্তারদের রেফারের ভিত্তিতে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
সচিব বরাবরে লিখিত আবেদনে মালেক হুসেন পীর উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন মাহবুব এর নেতৃত্বে ১১ জন পাক হানাদার সুনামগঞ্জে এসে আতঙ্ক তৈরি করে। তারা সুনামগঞ্জ সদর থানা দখল করে রাতে সার্কিট হাউজে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিটিআই ভবন দখল করে টর্চার সেল প্রতিষ্ঠা করে নারীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করে। যুদ্ধের পরপরই এখান থেকে নারীদের পরিধেয় বস্তু উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু বিএনপি সরকারের সময়ে ওই স্থানটি সংরক্ষণের বদলে ১৯৯২ সনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন পিটিআই বধ্যভূমির মূল স্থান সরকারি অফিসারের বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। তার বদলে পরিত্যক্ত স্থানকে বধ্যভূমি দেখিয়ে কয়েকটি পিলার দিয়ে লোকদেখানো সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। সম্প্রতি সরকার সারাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বিশেষ করে বধ্যভূমি, গণহত্যাস্থলসহ যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ায় মালেক পীর মূল বধ্যভূমি থেকে সরকারি পরিত্যক্ত স্থাপনাটি ভেঙে এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের আবেদন জানিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানী সেনারা সুনামগঞ্জে আসে। তাদের আগমন ও সশস্ত্র অবস্থানের খবর পেয়ে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জ ট্রেজারির তালা ভেঙে আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, জনতার মধ্যে রাইফেল ও গুলি বণ্টন করে প্রতিরোধের ডাক দেন। ২৮ মার্চ সকাল ১০টায় সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। দিন-রাত উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। রাতভর বৃষ্টির কারণে শেষ রাতে দুইজন জীবিত ও একজন আহত পাকিস্তানী সেনাকে রেখে অন্যরা পলায়ন করে। এরপরেই সুনামগঞ্জ প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ১০ মে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে উন্নত অস্ত্র নিয়ে আবারো শহরে প্রবেশ করে। তারা দখল নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের পিটিআই ঘাঁটি। সেখানে প্রতিষ্ঠা করে টর্চার সেল ও নারী নির্যাতন সেল। পাকিস্তানীরা শহর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরেই মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে চলে যান।
জানা গেছে, শহরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এ সময়ে স্থানীয় দালাল, রাজাকার, আল-বদরদের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট হোস্টেলের নিচের তলার পূর্বদিকের একটি কক্ষে টর্চার সেলে রেখে চরম নির্যাতন করা হতো। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু, মুসলিমসহ মুক্তিকামী বাঙালি নারী-পুরুষদের ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করতো। নারীদের উপর সংঘবদ্ধ পাশবিক নির্যাতন চালাতো পাকিস্তানি সেনারা। দূর থেকে এই টর্চারসেলের নারকীয় উল্লাস ও নির্যাতিতদের আর্তি শোনতে পেতেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সশস্ত্র অবস্থান ও মহড়ার কারণে তারা কিছুই করতে পারতেন না। নির্যাতনে যারা মারা যেতেন জল্লাদরা ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে অবস্থিত পি.টি. আই হোস্টেলের পুকুরের পশ্চিমের খালি জায়গায় তাদের লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখতো।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ত্রিমুখী আক্রমণের মাধ্যমে হটিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। পিটিআই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায় খান সেনারা। শহরে জয় বাংলা স্লোগান ও আর ফাঁকা গুলিতে উল্লাস করে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। আবারও পিটিআই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের পর স্থানীয় শিশুরা খেলাধুলা করতে গিয়ে অনেক হাড়গোড়ের খোঁজ পায়। তখন স্থানীয় প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধারা ওই বধ্যভূমির মাটি খুঁড়ে প্রায় ৫০-৬০টি মাথার খুলিসহ শহিদদের হাড়গোড় উদ্ধার করেন। এই হাড়ের স্তূপের মধ্যে নির্যাতিত নারীদের ব্যবহৃত নানা বস্তুও উদ্ধার করা হয়। এরপরই এই বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের মৃত্যুর পর এই বধ্যভূমিটি সংস্কারের বদলে এর স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। ১৯৯২ সালে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী নেতারা বধ্যভূমির উপর পি.টি.আই’র সুপারের পাকা বাসভবন নির্মাণ করে আলামত মুছে ফেলার উদ্যোগ নেয়। বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের বদলে সেখানে অধ্যক্ষের বাসভবন করে তারা। বর্তমান অধ্যক্ষের বাসভবনটিই বধ্যভূমি। এদিকে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা এর প্রতিবাদ করলে সংশ্লিষ্টরা কৌশলে মূল বধ্যভূমি থেকে পূর্বে স্থান সরিয়ে কয়েকটি ছোট পিলার দিয়ে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ করে। বর্তমানে বধ্যভূমি বহির্ভূত স্থানটির অস্তিত্ব থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা এটা অপসারণ করে ঐতিহাসিক মূল স্থানে বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/১ নং স্মারকে এখানকার বধ্যভূমি সংরক্ষণের অনুরোধ করেন সংশ্লিষ্টরা। গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর সদর উপজেলার সাবেক কমান্ডারের নিকট এই সংবাদ পেয়ে সদর উপজেলার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি এবং তার বন্ধু সুনামগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবু সুফিয়ান ও সদর ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার আতিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে পি.টি.আই স্কুলে নিয়ে আসেন এবং পি.টি.আই সুপারিনটেন্ডেট ও স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীসহ তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনসহ বধ্যভূমির প্রকৃত অবস্থানের একটি স্ক্যাচম্যাপ মার্কার দ্বারা অংকন করান। সংশ্লিষ্টদের হাতেকলমে অঙ্কন করে তিনি জানান, ১৪৪ নং জে.এল. সংক্রান্ত তেঘরিয়া মৌজার ১৬০৪ নম্বর খতিয়ানের ১৪৮৯ দাগের ০.২৫ একর ভূমিতে এই বধ্যভূমি অবস্থিত। মূল বধ্যভূমিতে বর্তমানে বর্তমানে একটি পাকা পরিত্যক্ত বাসভবন রয়েছে।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারি প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা পিটিআই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদেরকে সরেজমিন নিয়ে মূল বধ্যভূমি দেখিয়েছেন মালেক হুসেন পীর। আমরা সে অনুযায়ী এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিচ্ছি।
এদিকে বধ্যভূমি থেকে পরিত্যক্ত ভবন অপসারণ করে তা সংরক্ষণের জন্য মালেক হুসেন পীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক এবং সুনামগঞ্জ এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলীকেও আবেদনের অনুলিপি দিয়েছেন। আবেদনের সঙ্গে স্ক্যাচম্যাপ করে মূল্য বধ্যভূমি চিহ্নিত নকশাও অঙ্কন করে দিয়েছেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর বলেন, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই জানেন পিটিআই বধ্যভূমি কোথায়। বিএনপি আমলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বধ্যভূমির চিহ্ন মুছে বাসভবন বানানো হয়েছিল। সরকার বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রকল্প গ্রহণ করায় আমি এখান থেকে পরিত্যক্ত বাসভবনটি অপসারণ করে এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবিতে লিখিত আবেদন করেছি।
মালেক হুসেন পীরের সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, মালেক পীর এখনো লড়াই থামাননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষাসহ স্থানীয় অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এখনো আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ঢাকায় চিকিৎসার জন্য গিয়ে তিনি সুনামগঞ্জ বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।