বছর দুয়েক আগের কথা। প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সামনে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির পান্ডুলিপি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের বিশেষ সহকারী শাকিল। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো অসাধারণ এই আত্মকথনটির প্রথম প্রুফে চোখ বোলাতে পেরে। এমন সময় আচমকা ফোন এলো। ওপাশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী! ছুটির দিন সকালেও ব্যস্ততা। যে কারণেই হোক শাকিলের ফোনের স্পিকার অন ছিলো, ও দ্রুত সেটা অফ করে দেয়ার আগেই কানে এলো একটা বাক্য- প্রধানমন্ত্রী পাশে কাউকে অনুরোধ করছেন গরম মশলার কৌটোটা এগিয়ে দিতে। উনি রান্নাঘরে! রান্না করছেন নিজেই! একটা দেশের সর্বোচ্চ কর্ণধারের জন্য অতি অস্বাভাবিক চর্চা এটা। তাদের প্রচুর দাসদাসী থাকে। শেফ থাকে, স্পেশাল কুক থাকে। মুখে মেন্যু বলে দিলেই বাদশাহী খানাপিনা হাজির হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই বিলাসিতার সুযোগটা পায়ে দলে নিজেই রান্না করছেন! অভিভূত হয়েছিলাম বললে কম বলা হয়। পরে জেনেছি, এটি অতি স্বাভাবিক একটা ঘটনা তার জন্য। প্রিয় মানুষদের, অতিথি ও স্বজনদের জন্য নিজেই রান্না করেন শেখ হাসিনা। ঘরের মানুষের মতোই।
আন্তর্জাতিক এক আইটি কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ এক বড় ভাইর কাছে শুনেছিলাম তার অভিজ্ঞতা। একানব্বইর সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ডিজিটালি ভোট গণনার কাজ করছিলেন তারা। টিভিতে ঘোষিত ভোট সংখ্যা ডাটা হিসেবে এন্ট্রি করছিলেন কম্পিউটারে। ধানমন্ডী ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগের এবং ধানমন্ডী লেকের ওপারেই আরেকটি বাড়িতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ডিজিটাল ভোট গণনা চলছিলো। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের অংশটি তাদের জন্য ছিলো বিব্রতকর। তিনি সরাসরি জানতে চাইলেন কোনো কারচুপি চলছে না তো! এমন কোনো প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুমকিও দিয়ে দিলেন। ঘণ্টাদুয়েক পর লেকের ওপারে ভিন্ন চিত্র। শেখ হাসিনা নামাজ শেষ করে এসে প্রথমেই জানতেই চাইলেন সবার খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা! চা নাস্তা নিয়মিতই আসছিলো। কিন্তু তখন রাত প্রায় একটা বাজে। শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থেকে সবাইকে ভাত খাওয়াবার ব্যবস্থা নিলেন। খাওয়ালেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হারছে। ভ্রূক্ষেপ নেই। ‘আগে খেয়ে নাও সবাই, তারপর কাজ!’ এই অত্যন্ত আন্তরিক ও ঘরোয়া ব্যাপারটা আসলে অভিনয় করা যায় না, এটি সহজাত। মুগ্ধ বড় ভাই শেষ কথা হিসেবে বললেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ পছন্দ করি না। কিন্তু শেখের বেটির জন্য ভোটটা নৌকা ছাড়া কোথাও দিতেও পারি না!’ এই সম্বোধন এবং সেই সম্বোধনের আনুষঙ্গিক আবেগটুকু আসলে নিজের কানে না শুনলে ধরা যাবে না, অনুভব করা যাবে না।
এতো গেলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সার্বিক চিত্রটাও কিন্তু কমবেশী একইরকম। বিশ্ব রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই ‘লৌহ মানবী’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন যে জন, তাকেই কিনা দেখা যায় সাগর সৈকতে খালি পায়ে হাঁটছেন! সাগর জলে পা ভেজাচ্ছেন। সাধারণ ভ্যান রিক্সায় চড়ে গাঁয়ের পথে ছুটে চলেছেন। ক্রিকেট ম্যাচে মাঠে হাজির হয়ে পতাকা নাড়িয়ে জাতীয় দলকে উৎসাহ জোগাচ্ছেন! বিমানে আচমকা হাজির হয়ে সাধারণ যাত্রীদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন! সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে যেমন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অবসরে বেড়াতে বেরিয়ে বোন শেখ রেহানার সঙ্গে বরফের বল বানিয়ে ছোঁড়াছুড়ি করছিলেন! এসব কোনোটাই পলিটিকাল গিমিক ছিলো না। এসব বিষয় সাংবাদিক ডেকে ফটোসেশন করে প্রচারিত হয়নি। আশেপাশে থাকা মানুষজন অবাক বিস্ময়ে তাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোনে সেসব ছবি ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। নিমেষেই ভাইরাল হয়েছে সেসব। মানুষ অভিভূত হয়ে দেখেছে প্রটোকলের বাইরে থাকা তাদের প্রধানমন্ত্রীর অন্য রূপ! পরম ভালোবাসায় অনুভব করেছে তাদের প্রধানমন্ত্রী ভিনগ্রহের কেউ নন, দূরের কেউ নন। ঘরের মানুষ। প্রিয় বড় বোন, প্রিয় মায়েরই প্রতিরূপ। একইরকম দেখতে! এবং ভরসার জায়গা।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কথাই ধরুন। ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারী চ্যানেল আইতে ‘গানে গানে সকাল’ অনুষ্ঠানে গান গাইছিলেন এই স্বনামধন্যা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। সেদিন ছিলো তার জন্মদিন। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিলো। দর্শকরা শিল্পীর সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া করছিলেন টেলিফোনে। এমনই এক দর্শকের কণ্ঠে চমকে গেলেন বন্যা। সেই সঙ্গে টিভি দর্শকরাও! ইথারে ভেসে এলো: ‘বন্যাকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন বন্যা। তোমার সুরের মূর্ছনায় সারা বাংলাদেশ মোহিত হয়ে থাকুক, সেটাই আমি চাই। যুগ যুগ ধরে তুমি, তোমার এই সুরেলা কণ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কে আরও জাগ্রত করুক। আরও সুন্দরভাবে তুমি গান গেয়ে যাও। দীর্ঘজীবি হও। আমার দোয়া সবসময় তোমার জন্য থাকবে। আমি সবসময় তোমার গানের ভক্ত, সেটা তুমি জানো। তোমার জীবন আরও সুন্দর হোক, সফল হোক- সেটাই আমি চাই।’ এই কণ্ঠস্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার! আবেগাপ্লুত বন্যা কোনোমতে বললেন, ‘আপা রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন মনে পড়ে গেল- হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত। আজকের সকালে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো আপনার ফোন আমার জন্য সেরা উপহার। আপনি যে ফোন করে দোয়া করলেন, এটাই আমার বড় পাওয়া।’ বিষয়টা সবার কাছে স্পষ্ট হয়েই ধরা দিয়েছিলো। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফোন করেননি। করেছিলেন একজন সঙ্গীত অনুরাগী হিসেবে, বন্যার গানের একজন ভক্ত হিসেবে। একজন সাধারণ মানুষের মতোই জানান দিয়েছেন তাঁর অনুভূতি। একজন বড় বোনের মতোই আশীর্বাদ করেছেন একজন গুণী শিল্পীকে।
অবশ্য মানীগুণীদের জন্য শেখ হাসিনার এই অনুরাগ সবসময়ই ছিলো। কবি নির্মলেন্দ গুণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের রোগ শয্যায় উপস্থিত হয়ে তাকে আশ্বস্ত করা, তার চিকিৎসার ব্যয়ভার নেওয়া, প্রবাসী কবি শহীদ কাদরীর মরদেহ ঢাকায় এনে সমাহিত করা- এমন উদাহরণ অজস্র মিলবে। এ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন জাতীয় দলের ক্রিকেটার মেহেদী হাসান মিরাজ। গত বছর অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্ট ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। সমতায় শেষ সেই সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে সেরা খেলোয়ার নির্বাচিত হয়েছিলেন মিরাজ। সে সময় সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে দারিদ্রের সঙ্গে লড়ে বড় হওয়া এই ক্রিকেটারের সামাজিক অবস্থাও। খালিশপুরের এক রেন্টে কারের মাইক্রোবাস চালক মিরাজের বাবা। দোচালা এক টিনের ঘরে থেকেও ছেলেকে ক্রিকেটার বানিয়েছেন। বিষয়টি নজরে আসার পর মিরাজের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এক হাজার এক টাকার নামমাত্র মূল্যে মিরাজকে বাড়ি বানানোর জন্য একটি প্লট উপহার দেন তিনি। কয়েকদিন আগে সেই প্লটের কাগজপত্র বুঝে নিয়েছেন মিরাজের বাবা জালাল হোসেন। প্রাণভরে দোয়া করেছেন শেখের বেটির জন্য।
প্লটের কথায় স্মরণে এলো হাসমত আলীর নাম। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার এই দরিদ্র ভ্যান চালক বঙ্গবন্ধুর এতিম কন্যা শেখ হাসিনার জন্য একখন্ড জমি কিনেছিলেন জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে। চরম দারিদ্রতার মাঝে প্রায় বিনে চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করার আগেও সেই জমিতে হাত দিতে দেননি কাউকে। কি পরম ভালোবাসায় যাপিত জীবনের পুরোটাই আগলে রেখেছে এক খন্ড ভুমি! এই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জন্য অন্তত এক টুকরা জমিন আছে- তার অসাধারণ এক প্রকাশ নিয়ে। মৃত্যুর বছর পাঁচেক পর, ২০১০ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এই বিরল ভালোবাসার কাহিনী। হাসমত আলীর বিধবা স্ত্রী ভিখারিনী রমিজা খাতুনকে দপ্তরে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন শেখ হাসিনা, তার সারাজীবনের দায়িত্ব নেন। হাসমত আলীর সেই জমিতে রমিজা ও তার পরিবারের জন্য বাড়ি করে দেন এবং নিজে গিয়ে তাদের সেই বাড়িতে তুলে দিয়ে আসেন তিনি। ভালোবাসার জবাব ভালোবাসায় জানান দেন শেখের বেটি। এমন ভালোবাসার গল্প আসলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশজুড়েই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর যতদিন এর বিচার না হয়, যতদিন আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় না আসে- জুতা পায়ে না দেয়ার শপথ নিয়েছিলেন নান্দাইলের গ্রাম্য চিকিৎসক তফাজ্জল হোসেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তাকে পরার জন্য জুতো উপহার দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। মৌলভীবাজারের কাঠ মিস্ত্রী আতিক হাসানের কথাই বলি। পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি কাঠের চেয়ার বানিয়েছেন প্রায় দশ মন ওজনের। তার স্বপ্ন একটাই এটিতে শেখ হাসিনা বসবেন। শুধু তার জন্যই এই চেয়ার, আর কেউ এতে বসার অধিকার পায়নি এখনতক!
এমনি এমনি তো এমন ভালোবাসার যোগ্য হননি শেখ হাসিনা। এবং এই ভালোবাসা একতরফাও নয়। মানুষকে আপন করে নেয়ার এক বিরল গুণে গুনান্বিতা তিনি, ঠিক বাবার মতোই। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি ২০১০ সালে ঢাকার নিমতলীর সেই অগ্নিকান্ডের কথা। ১২৩ জন নিরীহ মানুষ মারা গিয়েছিলো সেই ভয়াবহ আগুনে, নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলো অগুনতি পরিবার। সবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আলাদা করে নিয়েছিলেন রুনা, রত্না ও শান্তা নামে তিন এতিম তরুণীর। নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের আপন করে নিয়েছিলেন। গণভবনে আয়োজন করে বিয়ে দেন তিন কন্যার। তিন জনের স্বামীকেই চাকরী দিয়েছেন। প্রত্যেকেই এখন স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে আছেন। বিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ ভাবেননি শেখ হাসিনা। নিয়মিতই তিনি খোজখবর রাখেন তার তিন মেয়ের। বিভিন্ন উৎসবে তারা নিমন্ত্রণ পায়। বছরে একবার ফল পাঠান প্রত্যেকের বাসায়। ঠিক মা যেমন করে!
আসলে বলে শেষ করা যাবে না এসব কথা। লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে কয়েক খন্ডের। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে যাকে সম্বোধন করে যাই নিয়মিত সাধারণ মানুষ সেই রাশভারীতাকে আমলেই নেয় না। তাদের কাছে তিনি শেখের বেটি। শেখ মুজিবরের মেয়ে। পাটের নায্য দাম পেয়ে উচ্ছসিত ৬০ বছরের কৃষক আমির হোসেন হোক, ১০ টাকা দরের চাল পাওয়া ফাতেমা বেগম হোক কিংবা ত্রান পেয়ে স্বস্তিতে ফেরা হাজেরা বিবি। সবার কাছে শেখ হাসিনা শেখের বেটি। তাদের অভিভাবক। দুর্দিনের ভরসা। দুর্দশার ভরসা। পরম আশ্রয়। যদিও তাদের স্বপ্নকে সত্যি করি মাঝে মাঝে তিনি সত্যিই হাজির হয়ে যান সামনে, জড়িয়ে ধরেন বুকে। কুড়িগ্রামের বন্যা দূর্গত ছুরোতভান বেওয়া যেমন দুচোখ জলে ভাসিয়ে ধারণ করেন সেই স্মৃতি, ‘বানের পানিত সউগ ভাসে নিয়্যা গেইছে। বানভাসী হামারগুল্যাক শেখের বেটি দেইখবার আইসবে স্বপ্নেও ভাবি নাই! নিজের হাত দিয়্যা হামাক ত্রান দিবে তাক চিন্তাও করি নাই।’
এটাই বাস্তবতা। রাজনীতিতে যখন স্যার বা ম্যাডাম ছাড়া নেতারা উত্তর দেন না, তখন শেখ হাসিনা সবার কাছে প্রিয় আপা। আদরের বড় বোন। যে পারুল বোনটির জন্য সাত ভাই চম্পারা লাখ লাখ হয়ে যায়। বুলেট বৃষ্টি গ্রেনেড বৃষ্টির মাঝেও দেয়াল হয়ে যায় বোনকে বাঁচাতে। দেশ জুড়েও তাই। পরম ভালোবাসায় মানুষ তার মাঝেই শেখ মুজিবকে খুজে পায়। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। গণ প্রজাতন্ত্রের অতি সাধারণ জনগনের কাছে যিনি শেখের বেটি। বাংলার রাখাল রাজার আদরের রাজকন্যা। জাতির জনকের গর্বিত উত্তরাধিকার। শুভ জন্মদিন…
(লেখাটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া)