কল্লোল তালুকদার::
বছর চারেক আগের কথা। বাংলা প্রমিত উচ্চারণ প্রশিক্ষণ কর্মশালা চলছে। প্রশিক্ষক ঢাকা থেকে আগত এক তারকা (!) বাচিক শিল্পী। তার নামটি আর নাই-বা বললাম। আকারে-ইঙ্গিতে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনিই দেশের শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার। বাকি সব এলেবেলে। যাইহোক, স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জন ধ্বনির উচ্চারণ শেখানোর এক পর্যায়ে তিনি তিনটি ‘শ’ এর পৃথক উচ্চারণ প্রসঙ্গে এলেন । নিম্ন কণ্ঠে আমি তখন তিনটি ‘শ’ এর সমান উচ্চারণের কথা তুলতেই, তিনি হলেন মহা চটিতং। কী মুশকিল! নরেণ বিশ্বাসের রেফারেন্স দিয়েও পার পেলাম না। তিনি বলেই বসলেন, “আরে রাখেন নরেণ বিশ্বাস, তার নিজেরই অনেক সমস্যা আছে”। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। সবার সামনে এক হাত নিলেন আমার উপর। কী আর করা, অতঃপর নীরবে সব হজম করে সুবোধ ছাত্রের মতো বসে থাকি। ঢাকা থেকে আগত তারকা বলে কথা! তবু তিনি বাক-বাকম করেই চলেন। কার সাধ্য তাকে বুঝায় যে, না জেনে বাক-বাকম করতে থাকলে, তা যতই চটকদার হোক না কেন এক সময় ভিতরের দৈন্য কেবলই প্রকাশ হয়ে পড়ে!
আমাদের শহরে সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন লোকসংগীত গবেষক আছেন, যিনি সর্বদা তহবন পরিধান করেন। সেই শৈশবও দেখেছি, যখনই কোনো কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তিনি হাজির থাকতেন, তখন প্রতিযোগীদের ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন তিন ‘শ’ এর উচ্চারণের পার্থক্য তারা জানে কিনা। আমিও বেশ কয়েকবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। তখন অবশ্য এর কারণটি বোধগম্য হতো না। তাই চুপ করে থাকাই ছিল শ্রেয়। কয়েক দিন আগে ফেইসবুকে একজন ভীষণ খেপে গেলেন তিন ‘শ’এর একই উচ্চারণের কথা শুনে। চটার অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। বাংলা বর্ণমালায় একটি নয় দুটি নয় তিন তিনটে ‘শ’। তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বিষয়টি বেশ জটিল।
তিন ‘শ’ এর উচ্চারণের অভিন্নতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক নরেণ বিশ্বাস একটি মনোজ্ঞ উদাহরণ দিয়েছিলেন। ভারত চন্দ্রের অন্নদা মঙ্গল কাব্যের নায়িকা অন্নদা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। পথে একাকিনী এক কুলবতীকে দেখে ঈশ্বরী পাটনি তাঁকে জিজ্ঞেস করে,
-একা দেখি কুলবধূ, কে বটে আপনি?
-বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি, জান তো হে স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী।
এই ‘বিশেষণ’ আর ‘সবিশেষ’ শব্দ দুটির উচ্চারণে ‘শ’ এর ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই। ‘সবিশেষ’-এ তিনটি ‘শ’-ই আছে, কিন্তু তিনটির উচ্চারণই একদম সমান, একই ওজনের। ধ্বনিরূপ সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন। যে কোনো ভালো অভিধান অথবা উচ্চারণ অভিধান দেখলেই তা বুঝা যাবে। বানান ‘সবিশেষ’, কিন্তু উচ্চারণ [শবিশেশ], (দ্র. বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ: ১১১৮)। এটি ব্যতিক্রম নয়। বরং বাংলাভাষায় এটাই শুদ্ধ নিয়ম। বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে ভিন্ন নিয়ম। বানান ভেদের জন্যই মূলত বাংলা বর্ণমালায় এই তিনটি বর্ণ রাখা হয়েছে। তাই নরেণ বিশ্বাস বলেন, ‘তালব্য’, ‘মূর্ধন্য’, ও ‘দন্ত্য’ বলে তিন ক্ষেত্রেই শেষে কিন্তু বলতে হয় ‘শ’। কিন্তু বানান ভুল হলে তো আর রক্ষে নেই। তাই প-িত মশাই যতই সতর্ক করুন না কেন, “দ্খ্ েরে বাবা, যাচ্ছিস পরীক্ষার হলে; সুশীতল সমীরণ লেখতে যদি শঙ্কা জাগে চিত্তে, লিখিস না। লিখে দিস- ঠা-া হাওয়া।” অতএব বাতাসও ঠা-া হয়ে যাবে, ‘শ’ এর ভুলও আর হবে না। কিন্তু এভাবে কী ‘শ’ এর সমস্যা এড়ানো যায়? এর জন্য দরকার বিধিবিধান জানা। জানা দরকার এই তিনটি ‘শ’ এর আদৌ কোনো সার্থকতা আছে কিনা।
এই নিয়ম অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং ভীষণ সহজও বটে। এক্ষেত্রে নিয়ম হলো:
১। চেহারা ভিন্ন হলেও বাংলাভাষায় মূল ধ্বনি হিসেবে প্রধানত একটি মাত্র ‘শ’ উচ্চারিত হয়।
২। কিন্তু যখন ‘শ’ সহ-ধ্বনি (allophone) হয়ে যায়, অর্থাৎ সংযুক্ত অবস্থায় অন্য ধ্বনির প্রভাবে ‘শ’ এর উচ্চারণ কিছুটা ‘ছ’ (ইংরেজি ‘s) এর মতো হয়ে যায়। অর্থাৎ যখন-
(ক) দন্ত্য (denta) ধ্বনি দত’, ও দথ’ এবং দন্ত্যমূলীয় (alveolar) ধ্বনি দন’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়, যেমন: মস্তক, সমস্ত, দরখাস্ত, স্থান, প্রশ্ন, স্নেহ ইত্যাদি;
(খ) দন্ত্যমূলীয় পার্শ্বিক ধ্বনি (voiced unaspirated alveolo-lateral) দল’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়, যেমন: অশ্লীল, শ্লথ, শ্লাঘা ইত্যাদি;
(গ) দন্তমূলীয় কম্পনজাত ধ্বনি (voiced unaspirated alveolo-trilled) ‘র’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়, যেমন- শ্রমিক, শ্রবণ, স্রোত, শ্রাবণ ইত্যাদি।
এই নিয়ম কারো মনগড়া নয় অথবা এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। বরং এই নিয়ম বিজ্ঞানসম্মত। ত, থ, ন, র এবং ল এই ধ্বনিগুলোর সঙ্গে যখন সংযুক্ত অবস্থায় ‘শ’ ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন সেই ধ্বনিগুলো উচ্চারণের জন্য জিহ্বা যে প্রস্তুতি নিচ্ছে; অর্থাৎ দন্ত্যমূলে যাওয়ার জন্য জিহ্বার যে প্রবণতা থাকে; সেই প্রবণাতার জন্য ‘শ’ এর উচ্চারণ কিছুটা ‘ছ’ অর্থাৎ ‘ইংরেজি এস’ এর মতো হয়ে যায়।
লেখক: হাওরের জীববৈচিত্র বিষয়ক গবেষক, কবি ও লেখক।