অনলাইন ডেস্ক::
বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের খসড়া প্রার্থী তালিকা দলটির গুলশান কার্যালয়ে প্রস্তুত হচ্ছে। কাজ শেষ হলে ওই তালিকা পাঠানো হবে লন্ডনে বসবাসরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে।
সূত্র মতে, বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডের তৈরি করা খসড়া তালিকা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত মনোনয়ন তারেক রহমানই ঠিক করবেন। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরাই মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থিতা যেভাবে ঠিক করা হয়, বিএনপিও একই প্রক্রিয়ায় এবং যৌথভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করবে। তাঁর মতে, ব্যক্তিগত পছন্দ বা ঘনিষ্ঠতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনা কতটুকু? এ বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে মনোনয়ন বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি জোটের তালিকা তৈরিতে সময় লাগবে। তিনি জানান, এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। এরপর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হবে।
গতকাল শুক্রবার ও আগের দিন বৃহস্পতিবার দুই দফা বৈঠক করে খসড়া তালিকা নিয়ে আলোচনা করে বিএনপির মনোনয়ন বোর্ড।
মূলত গত ১৮ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত দলীয় দুই হাজার ৬০০ আগ্রহী প্রার্থীর সাক্ষাৎকার থেকে সংক্ষিপ্ত (শর্টলিস্ট) খসড়া তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে।
জানা গেছে, খসড়ায় প্রত্যেক আসনে আগ্রহী একাধিক প্রার্থীর যোগ্যতার পাশাপাশি এলাকায় তাঁর অবস্থান এবং জয়লাভের সম্ভাবনা নিয়ে মন্তব্য থাকবে। এভাবে ৩০০ আসনে একাধিক দলীয় প্রার্থী এবং শরিক দলগুলোর প্রার্থীর নামসহ খসড়া তালিকা পাঠানো হবে লন্ডনে। তবে কোন আসনে কে বিএনপি বা জোট প্রার্থী হচ্ছেন, তা ঘোষণা করতে আরো বেশ কয়েক দিন সময় নেবে দলটি। বিশেষ করে কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রার্থী ঘোষণার পরই তারা ওই ঘোষণা দিতে চায়। উদ্দেশ্য হলো—বিএনপি বা জোটের মনোনয়নবঞ্চিতরা যাতে আওয়ামী লীগে যোগদান না করতে পারেন।
নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর নির্ধারিত হলেও মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৮ নভেম্বর, বাছাই ২ ডিসেম্বর এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় আগামী ৯ ডিসেম্বর হওয়ায় বিএনপি প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ঝুঁকি এড়াতে আপাতত একাধিক বিকল্প প্রার্থী মনোনয়নপত্র কমিশনে জমা দিলেও চূড়ান্তভাবে একজনকে রেখে বাকিদের প্রত্যাহার করতে বলা হবে। প্রার্থীদের কাছ থেকে আগেই এ ব্যাপারে হলফনামা বা অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করিয়ে রাখা হবে যাতে বিএনপি চিঠি দিলেও একটি বাদে অন্য প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার হয়ে যায়।
আরপিওর ১৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘বৈধভাবে মনোনীত কোনো প্রার্থী তাঁর দস্তখতযুক্ত একটি লিখিত নোটিশ প্রত্যাহারের দিন বা এর আগে রিটার্নিং অফিসারের কাছে স্বয়ং বা এতদুদ্দেশ্যে তৎকর্তৃক লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো প্রতিনিধি মারফত দাখিল করিয়া তাহার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করিতে পারিবেন। ’
যদিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপি নেতারা বলছেন, খসড়া তালিকার আগেও অনেক আসনে প্রার্থিতা নিয়ে টেলিফোনে তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে মনোনয়ন বোর্ড সদস্যদের। তা ছাড়া বর্তমান বাস্তবতায় তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে নয়, মনোনয়ন বোর্ডের সুপরিশের আলোকেই বেশির ভাগ আসনের প্রার্থী ঠিক করা হবে। তবে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে দু-চারজন প্রার্থী মনোনয়ন পাবেন—এটি স্বাভাবিক বলেই ধরে রেখেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র নেতারা।
কয়েক দিন ধরেই গুলশান কার্যালয়সহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বাসায় বাসায় আগ্রহী প্রার্থীদের ভিড় লক্ষ করা গেছে। তাঁরা মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ বা লবিং করছেন। তবে লবিং করতে যাওয়া আগ্রহী একাধিক প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, সিনিয়র নেতারা প্রত্যেকের অনুরোধ বা দাবির কথা শুনলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লন্ডনে হবে বলে জানিয়েছেন।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দলগুলো ইতিমধ্যে তাদের দাবিকৃত প্রার্থী তালিকা বিএনপির কাছে জমা দিয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে দুই ধরনের তালিকা দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একটি লম্বা তালিকা যেটি প্রতিটি দল তাদের নেতাদের খুশি করার জন্য দিয়েছে। অপরটি হলো—জয়লাভের সম্ভাবনা আছে বা একান্তভাবে না দিলেই নয় এমন প্রার্থী তালিকা। সূত্র মতে, ওই তালিকা নিয়েই বিএনপির সঙ্গে দর-কষাকষি করছে শরিক দলগুলো। তারেকের কাছে যে তালিকা পাঠানো হবে তাতে শরিক দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীর নামও থাকবে বলে বিএনপি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র মতে, ২০ দলীয় জোটের মধ্যে জামায়াত এবং এলডিপি বেশি অগ্রাধিকার পাবে। তবে জামায়াতের সঙ্গে আসন বণ্টন খুব সহজ হবে না। কারণ দলটি এবার কমপক্ষে ৪০টি আসন চাইছে, যা সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের চেয়ে পাঁচটি বেশি। দলটির প্রভাবশালী পাঁচ নেতার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ায় বিএনপি মনে করছে দলটি দুর্বল অবস্থায় আছে। তাছাড়া জামায়াতের নিবন্ধনও বাতিল করেছে ইসি। এ অবস্থায় দলটিকে শেষমেশ স্বতন্ত্র নির্বাচনও করতে হতে পারে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে। তাই ২০ থেকে ২৫টি আসনের বেশি তাদের প্রাপ্য নয় বলে বিএনপি মনে করছে। অন্যদিকে জামায়াত মনে করে, তারা আগের তুলনায় শক্তিশালী। তা না হলে বিএনপি তাদের জোটে রেখেছে কেন?
বিএনপির খসড়া তালিকায় দুই জোটের নিশ্চিত আসনগুলোর কথা উল্লেখ করা হবে বলে জানা গেছে। সূত্রের দাবি, ওই তালিকায় এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদ (চট্টগ্রাম-১৪), রোদোয়ান আহমেদ (কুমিল্লা-৭), শাহাদাত হোসেন সেলিম (লক্ষ্মীপুর-১), আবদুল করিম আব্বাসীর (নেত্রকোনা-২) নাম থাকবে। এ ছাড়া ভোলা-১ আসনের জন্য বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থর নাম থাকবে। যদিও পার্থ ভোলার পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর একটি আসন থেকেও নির্বাচন করতে আগ্রহী। ঢাকায় তরুণ ভোটারদের মধ্যে পার্থর জনপ্রিয়তা আছে এমন বিবেচনায় বিএনপির মধ্যেও তাঁকে ঢাকায় একটি আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা আছে।
এ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের অন্য শরিকদেরও একটি বা দুটি করে আসন দেওয়ার কথা আলোচনা হয়েছে বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডে। এর মধ্যে কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমের জন্য চট্টগ্রাম-৫, জাগপার শফিউল আলম প্রধানের মেয়ে তাসমিয়া প্রধান পঞ্চগড়-২, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের রীতা রহমান নীলফামারী-১, জমিয়তে ওলামায়ে মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের জন্য যশোর-৫, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের হবিগঞ্জ-৪, এনপিপির সভাপতি ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নাম পিরোজপুর-২ আসনের জন্য তালিকায় স্থান পেতে পারে।
ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের জন্য ঢাকা-১০, মোস্তফা মহসীন মন্টুর জন্য ঢাকা-৭, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর জন্য ঢাকা-৬, ঐক্যপ্রক্রিয়ার সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের নাম মৌলভীবাজার-২ আসনের জন্য তালিকায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের জন্য জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং কুমিল্লা-৪ আসনের জন্য আবদুল মালেক রতনের নাম তালিকায় থাকতে পারে। তবে একটি সূত্রের দাবি, রবকে লক্ষ্মীপুরে না দিয়ে ঢাকার একটি আসনে নির্বাচন করার অনুরোধ করছে বিএনপি। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। জেএসডি আরো দু-একটি আসনের জন্য দর-কষাকষি করছে বলে জানা গেছে।
কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টির সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নাম টাঙ্গাইল-৪ ও টাঙ্গাইল-৮ এই দুই আসনের একটির জন্য থাকবে। যদিও তিনি দুটি আসন দাবি করছেন বলে জানা গেছে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২ আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। বিএনপি ছাড় দিলে দলটির উপদেষ্টা এস এম আকরামকে দেওয়া হতে পারে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে। এ ছাড়া দলীয় নেতা নঈম জাহাঙ্গীরের জন্য জামালপুর-৩ এবং মো. মোবারক হোসেনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটি নিয়ে দর-কষাকষি করছে দলটি।