বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্টে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নের অভিযোগ তুলে কামাল হোসেন বলেন, এর জন্য তাদের শাস্তি পেতে হবে, এখানে কোনোভাবে পার পেলেও পরকালে ছাড় পাবে না। কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী জেতানোর চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
প্রায় একই সময় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘ব্যবসায়ী সম্মেলনে’ বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, “এখানে জনগণ ভোট দেবে, যাকে দেবে তারাই ক্ষমতায় আসবে। আমার এমন কোনও আকাঙ্ক্ষা নাই যে, যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যদি ক্ষমতায় আসতে পারি আলহামদুলিল্লাহ। যদি না পারি কোনও অসুবিধা নাই।
“কিন্তু দেশে শান্তি বজায় থাকুক, দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়ে তার সরকার পছন্দ করে নিক। সেই পরিবেশটা বজায় থাকুক, আমি সেটাই চাই। কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশটা থাকলে দেশটা এগিয়ে যাবে।”
ত ১০ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। নোয়াখালী ও ফরিদপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় দুই আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, মাহবুব উদ্দিন খোকন, আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ দলটির ডজনখানেকের বেশি প্রার্থীর গাড়িবহর ও সমাবেশে হামলা হয়েছে। প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলার অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা।
নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা চাই নির্বাচনটা শান্তিপূর্ণ হোক। আপনাদের কাছ থেকে একটা সহযোগিতা চাই, আজকে যে সুন্দর-শান্তিপূর্ণ পরিবেশটা আছে। সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রেখেই যেন নির্বাচনটা হয়, সেই পরিবেশটা যেন বজায় থাকে।”
অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও ছাড়াও বিভিন্ন গ্রুপ অব কোম্পানিজের মালিক, দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ ব্যবস্থাপকরা উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন।
বাস্তবায়নাধীন মেগাপ্রকল্পগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এতগুলো কাজ হাতে নিয়েছি। কোনও দিক বাকি রাখি নাই। সব দিকেই উন্নয়ন করে যাচ্ছি।”
পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ‘হাওয়া ভবন’ তৈরি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ‘যেভাবে চাঁদা আদায় করা হয়েছিল’ তারও অবসান ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনাদের জন্য যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করেছি, এখনতো আর বলতে পারবেন না যে, কেউ হাওয়া ভবন খুলে সব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থাবাথাবি করছে যে, কিছু করতে গেলেই ভাগ দিতে হবে। অন্তত আমরা সেটা করি না, করব না- এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা।
“ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে। সরকার হিসেবে দায়িত্ব ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা।”
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যার হাতে দেশের প্রতিটি খাতের উন্নয়নের রূপরেখা রয়েছে।
“১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলেছিলাম, ২০ হাজার মেগাওয়াট করেছি। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি, ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৩ কোটি মোবাইল সিম। এগুলো ব্যবসা- বাণিজ্যকে সহজ করে দিচ্ছে।”
বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বানানোর স্বপ্নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। জাতির পিতা একটা কথা বলতেন যে, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। সুইজারল্যান্ডের ভৌগলিক অবস্থানটা যদি দেখেন, ইউরোপের এক দিক থেকে আরেক দিক যেতে গেলে সুইজারল্যান্ডকেই ব্যবহার করতে হয়। একটা শান্তিপূর্ণ দেশ।
“তিনি বাংলাদেশটাকেও সেইভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে বাংলাদেশ। কিন্তু তার জন্য একটা অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন। আর সেই উন্নয়নের কাজও আমরা হাতে নিয়েছি। আর প্রতেবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একটা যোগাযোগ ও সদ্ভাব সৃষ্টি করা, সেটাও আমরা খুব সফলতার সাথে করতে পেরেছি।”
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে ঝগড়া না করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ মেটানো ও স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নেরও কথা উল্লেখ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “সেই সাথে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান আমরা অব্যাহত রাখব, যাতে আমাদের সমাজে শান্তি ফিরে আসে।”
তার সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালা শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক নয়, গ্রাম পর্যন্ত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “দুর্নীতি করে নিজের ভাগ্য গড়তে আসিনি। ভাগ্য গড়তে এসেছি, বাংলার জনগণের। সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি করাটাই আমার লক্ষ্য।
“অনেকেই বলে, আপনি সারা দিন-রাত এত পরিশ্রম করেন কেন? আমার বাবা এ দেশটা স্বাধীন করে দিয়েছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। সেটা তিনি করতে পারেননি। তার সেই অসামপ্ত কাজটা শেষ করা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি, কর্তব্য হিসেবে নিয়েছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখেছে। তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের জন্য কী রাখতে হবে, না হবে ওই চিন্তা কখনো করি না। আমি চিন্তা করি, বাংলাদেশের মানুষের জন্য কী রেখে গেলাম, কী করে গেলাম, ভবিষ্যতের জন্য কী করব। সকলের ছেলে-মেয়েই ভবিষ্যতে সুন্দর জীবন পাক, সেটাই আমি চিন্তা করি। আর সেভাবেই আমাদের সকল কর্মকাণ্ড, সকল পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি।”
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য ১০০টা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হবে, কর্মসংস্থান হবে।
“পাশাপাশি কৃষিকাজকে আধুনিক যান্ত্রিকীকরণ করে দেব। যাতে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায়, সেভাবে আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেজন্য আপনাদের কাছে সহযোগিতা চাইব।”
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ৩০ ডিসেম্বর নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাকে আরেকবার সুযোগ দিন আপনাদের সেবা করার। হাতে নেওয়া কাজগুলো যেন সম্পন্ন করতে পারি।”
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইসিসির সভাপতি মাহবুবুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির, এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাত কবীর, সাবেক সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান, প্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল ফোলি, মাইক্রোসফট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সোনিয়া বশীর কবির, সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, বিএসআরএম স্টিলের চেয়ারম্যান আলী হুসেন আকবর আলী, বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ, এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুপালী চৌধুরী, মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক, বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর প্রমুখ।