শরণার্থী ক্যাম্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে এখন রোহিঙ্গা কিশোরী ফরমিন আখতার। তাও এশিয়া অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এ।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে। তার পাশেই চট্টগ্রাম জেলার শহরে স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এই অদম্য রোহিঙ্গা কিশোরী নিয়ে প্রকাশ করে একটি ভিডিও প্রতিবেদন। এরপর চ্যানেল নিউজ এশিয়া, বিজনেস ইনসাইডার, এনডিটিভিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ছাপে ওঠে আসে ১৯ বছর বয়সী ফরমিনের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প। সুবিধাবঞ্চিত নারী হিসেবেই অন্য অনেকের মতো এখানে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো শিক্ষার্থী এখানে পড়ার সুযোগ পেল।
অন্যান্য দেশের মেয়েদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের প্রথম দিনে স্বাভাবিকভাবেই জড়সড় ছিলেন তিনি। ইতস্ততবোধ করছিলেন, মিশতে পারছিলেন না বিদেশি ছাত্রীদের সঙ্গে। টাইট জিন্স, স্লিভলেস টপ এবং টি-শার্ট পরে ইংরেজিতেই কথা বলছিলেন সবাই। সেখানে একটি ঢোলা প্যান্ট এবং জামা পরে ক্লাসের একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন ফরমিন। মাথা থেকে বারবার পড়ে যাচ্ছিল তার বাদামি স্কার্ফ। হয়তো ভাবছিলেন মিয়ানমারের ভয়ংকর সেসব স্মৃতি, শরণার্থী শিবিরের দুর্বিষহ সেইসব দিনগুলোর কথা। এটাও হয়তো ভাবছিলেন নানা দেশ থেকে আসা তার চেয়েও অবস্থাসম্পন্ন মেয়েদের সঙ্গে ঠিকঠাক মিশতে পারবেন কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু স্বপ্নপূরণের দৃঢ়তায় সে শঙ্কা কেটে যায় ফরমিনের। তার পোশাক-আশাক ও দৃষ্টি ঠিকই খেয়াল করে সহপাঠীরা। সকলের চোখ যখন তার দিকে সেও কী করবে বুঝতে না পেরে এগিয়ে এসে দেখায় তার আইডি কার্ড। বলে, আমিও তোমাদের একজন।
এই আইডি কার্ড নিয়ে তিনি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রবেশ করেননি, প্রবেশ করেছেন অন্য এক স্বপ্ন জগতে। শরণার্থী ক্যাম্পের উন্মুক্ত বন্দিজীবন থেকে এক মুক্ত পৃথিবীতে পা রাখলেন যেন। রাখাইনেই ১৯৯৯ সালে জন্ম তার। সেখান থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীদের বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে আসেন তিনি। অল্পবয়স থেকেই পড়াশোনার জন্য ক্ষুধা ছিল তার। কিন্তু রাখাইনে শিক্ষাবঞ্চিত থাকা সংখ্যালঘু মুসলিম জাতিগোষ্ঠীরই সন্তান হওয়ায় এ ক্ষুধা মিটবার নয়। কিন্তু বড় হতে হতে তার মধ্যে শিক্ষিত হওয়ার তাড়না বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বাবাই চেয়েছিলেন দুই মেয়ে নুরজাহান এবং ফরমিনকে অনেক আদর-যত্নে বড় করবেন, পড়াশোনা করাবেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিবিরে মৃত্যু আর ধর্ষণ চোখের সামনে দেখতে দেখতে স্বপ্নগুলো মিইয়ে যাচ্ছিল পরিবারটির। ক্যাম্পে কিছুদূর পড়াশোনার সুযোগ পেলেও নুরজাহানের বিয়ে হয়ে যায় অল্পবয়সে, এখন তিনি সন্তানসম্ভবা। তিনিই ছোটবোন ফরমিনকে স্বপ্ন দেখান পড়াশোনার।
এই দুই রোহিঙ্গা মেয়ের ৭৯ বছর বয়সী দাদু জানায়, ফরমিনের থেকেও বেশি মেধাবী ছিল নুরজাহান। কিন্তু ও পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারল না। তার বিয়ে হয়ে গেল। আসলে আমাদের মতো জীবনে সব ইচ্ছা সফল হয় না।
এক রোহিঙ্গার সঙ্গেই নুরজাহানকে বিয়ে দিয়ে দেন তার বাবা। পাত্র সৌদি আরব শুনে আর স্থির থাকতে পারেনি তিনি। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে দীর্ঘদিন পড়াত নুরজাহান।
নুরজাহানই পড়াশোনার স্পৃহা সৃষ্টি করে দেন ফরমিনের মধ্যে। সেই স্পৃহা এবং অদম্য ইচ্ছায় তিনি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে। বড়বোনের স্বপ্ন পূরণ না হলেও উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন এখন হাতের মুঠোয় ফরমিনের। আইন বিষয়ে পড়ার ইচ্ছা তার। রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবনে নানা সমস্যা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে মেটাতে চান তিনি। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর তার ইচ্ছা, কখনো অং সান সুচির মুখোমুখি হলে জিজ্ঞাসা করবেন- আপনিও তো আমার মতো একজন নারী। একবার আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখবেন, আপনার ঠিক কেমন লাগে?
ক্যাম্পের বন্দি জীবনের মনের যাবতীয় কথা লিখে রাখতেন ডায়েরিতে। সেখানে একদিন লিখেছিলেন, বড়বোন নুরজাহানকে আবার পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন তিনি।
তিনি লিখেন, “আপাকে বেশিদিন কষ্ট করতে হবে না। ওকেও কলেজে পড়াব আমি। দুই বোন একসঙ্গে পড়ব। সে না থাকলে আমার পড়া হতো না। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা অন্যদের মতো আমাদেরও মেরে ফেলতো। আপার কারণে আমি বেঁচে গেছি। নইলে কখনো বেরিয়ে আসতে পারতাম না সেই নরক থেকে। হয়তো এতদিনে মরেই যেতে হতো। অথবা, দিনের পর দিন ধরে ধর্ষিত হয়ে পড়ে থাকতে হতো কোনো অন্ধকার কুঠুরিতে। আপাই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। দেশ ছেড়ে এসেও এখনো অন্ধকারে থেকেই গেছে রোহিঙ্গারা। বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন- আমাদের শিক্ষার আলো দেখাবেন। শিক্ষার সে আলোটুকু আমাদের চাই।”