পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে দাপিয়ে বেড়ানো রাজনীতির এক ক্ষণজন্মা পুরুষ আব্দুজ জহুর। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বিন্নাকুলি গ্রামে ১৯২৫ সালের ১০ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে।
বিন্নাকুলি গ্রামের তালুকদার বাড়ির ঠাকুর ধন তালুকদারের সাত ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভীষণ ঝোঁক ছিল তাঁর। ছয় বছর বয়সে নিজ বাড়িতে মামার কাছে লেখাপড়া দীক্ষা নেন। তখনকার সময়ে আশে-পাশে কোনো স্কুল না থাকায় নিজ বাড়িতে মামার কাছে পড়ে মামার কাছে প্রথম শ্রেণির পরীক্ষা দেন এবং সফলতায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৩৭ সালে রাজারগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে তিনি গৌরারং মধ্য ইংরেজি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে চার বছর লেখাপড়া করার পর মাধ্যমিক বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৯৪২ সালে সারা ভারত বর্ষ জুড়ে ছটওঞ ওঘউওঅ গঙঠঊগঊঘঞ শুরু হলে তার প্রভাব গ্রামাঞ্চলেও পড়ে। তখন মাত্র ১৭ বছরের ছাত্র আব্দুজ জহুর কঠোরভাবে তা মোকাবেলা করেন। ১৯৪২ সালের ছটওঞ ওঘউওঅ গঙঠঊগঊঘঞ এর পর ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সারা বিশ্বজুড়ে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করে সর্বত্র। এর প্রভাব সুনামগঞ্জেও পড়ে। ফলে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আব্দুজ জহুর তাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসকরা ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৫০ সালে সারা দেশ জুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দমনে ছাত্র সমাজ সরাসরি অংশগ্রহণ করে। তখনকার সময় ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে জেলা হতে গ্রাম পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে সভা-সমাবেশ করে বেড়ান তিনি।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” সেই আন্দোলন চলছিল জিন্নাহ, নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। সে সময় তিনি সিলেট এমসি কলেজ থেকে ¯œাতক ডিগ্রি পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ল’-তে ভর্তি হন। ফলে ভাষা আন্দোলনে তিনি দু’জায়গাতেই অর্থাৎ সিলেট এবং ঢাকাতেই আন্দোলন করেন।
১৯৫৪ সনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পতনেও একজ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের মাসখানেক পর বিভিন্ন বাহানা তুলে সরকার বাতিল করে ৯২(ক) ধারা জারি করা হয়। সেই সময় জন-নিরাপত্তা আইনে জেলে বন্দী করে রাখা হয় আব্দুজ জহুরকে। ১৯৫৪ সালে প্রথম তিনি কারাবন্দী হন এবং দশ মাস জেল খাটেন।
১৯৪৭ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন আব্দুজ জহুর। সিলেটের গণভোটেও সক্রিয় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে গণতান্ত্রীক দলে যোগদান করে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে আব্দুজ জহুরের ভূমিকা ছিল সক্রিয়। রাজনীতিতে নিবেদিত আব্দুজ জহুর ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে বেগম রহিমা জহুরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
আব্দুজ জহুর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। তিনি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন এবং টেকেরঘাট সাবসেক্টরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃত। সুনামগঞ্জের যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আব্দুজ জহুরকে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সুরঞ্জিত সেনরগুপ্তের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৯ মাস প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন অসহায় মানুষদের সুখ-দুঃখের বর্ণনা নিতে। যা কিছু আছে তা দিয়েই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়েছেন ক্ষুধার্ত মানুষদের। সেবার কাজ করেছেন আহত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে। একজন সংগঠক হিসেবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়েছেন দীনার্থ মানুষের পাশে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্ব-পরিবারে হত্যার পর বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক এর বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে মামলা করে কারাবন্দী করে রাখা হয়।
কারাবন্দী প্রসঙ্গে আব্দুজ জহুর সাহেবের বড় মেয়ে ফাতেমা চৌধুরী স্বপ্নার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়Ñ ১৯৭৫ সালে আব্দুজ জহুরকে গ্রেফতার করে প্রায় দুই বছর কারাগারে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কিন্তু তিনি কখনো নীতি কিংবা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। কোনো প্রলোভন তাঁর নৈতিকার অধঃপতন ঘটায়নি। তাঁকে পৃথম সেলে রাখা হয় এবং সেখানে তাঁর মাথার ওপর দু’টি হাই ভোল্টেজ বাল্ব দিনে-রাতে জ্বালিয়ে রাখা হয়। প্রায় দুই বছর জেলে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করেও উনাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। জেল থেকে বেরিয়ে আবার সর্বহারা মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে সপে দিয়েছিলেন গণমানুষের এই নেতা।
আব্দুজ জহুর ১৯৯১ সালে ৩য় বারের মত আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দীর্ঘ ৫ বছর এ আসনের প্রতিনিধি থেকে শুধুমাত্র সংসদীয় এলাকায় নয় সমগ্র জেলাব্যাপী ব্যাপক উন্নয়নমূল কাজ করেছেন। তিনি সর্বোপরি ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি সময়ে সময়ে বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।
(লেখাটি প্রকাশিতব্য আব্দুজ জহুর স্মারকগ্রন্থ থেকে সংকলতি)
##
রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু, আমেরিকাপ্রবাসী সাংবাদিক গবেষক, প্রধান সম্পাদক হাওরটুয়েন্টিফোরডটনেট।