1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:১৯ অপরাহ্ন

এলো বনান্তে পাগল বসন্ত: জয়নাল আবেদিন শিমুল বাগানে বসন্তপ্রেমিদের ভিড়

  • আপডেট টাইম :: বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, ৮.৪১ এএম
  • ৫০১ বার পড়া হয়েছে

শামস শামীম
‘সহসা খুলিয়া গেল দ্বার/ আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি/দাড়াল করিয়া নমস্কার’ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তের জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগান বসন্ত বিলাসীদের লাল তোড়ণ বিছিয়ে স্বাগত জানাবে আজকের বসন্ত দিনে। দলে দলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা বয়সের মানুষজন মন রাঙাতে ছুটে আসার ঘোষণা দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাগানের স্বত্বাধিকারীরাও হাজারো সৌন্দর্য্য পিয়াসীদের স্বাগত জানাতে বসন্তবরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। আনন্দ গানে আজ আড়াই হাজার বৃক্ষসম্বলিত দেশের সর্ববৃহৎ শিমুল বাগানে লালশিমুলের বাড়িতে মেতেছেন তারা। ঋতুরাজ বসন্ত আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে বাগান জুড়ে। উত্তাপহীন এই আগুনে কেবল মন রাঙ্গানোরই যতসব আয়োজন।
বাগানঘেঁষা ঘনসবুজের খাসিয়া পাহাড়, স্বচ্চতোয়া জলের ঝলমলে রূপের নদী যাদুকাটা এককালের ভরাট হওয়া মাহরামের মরুময় মরুময় বিস্তুীর্ণ বালুপ্রান্তর-প্রকৃতিসুন্দর এমন একটি স্থানেই তাহিরপুরের বৃক্ষপ্রেমী আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন শখের বসে শিমুল বাগানটি করেছিলেন। দেশের সর্ববৃহৎ এই শিমুল বাগানে মানুষ এসে আনন্দে মাতবে, প্রকৃতির বন্দনা করবে, প্রকৃতির সুরক্ষার পাঠ নিবে এই ছিলই তার ইচ্ছে। কিন্তু মানুষটি রূপছড়ানো বাগানটিতে বসন্তের জাগরণ দেখে যেতে পারেননি। এ কারণে তার সন্তানরা এখনো অন্তহীন আফসোস করেন।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের সীমান্তগ্রাম মানিগাঁওয়ে প্রায় দুইযুগ আগে ১৯৯৬ সনে বাগানে গাছ লাগাতে শুরু করেন বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত জয়নাল আবেদীন। তিনি বাগানটিকে দেশের সর্ববৃহৎ শিমুলবাগানে রূপ দিতে দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রকৃতিবিদ ও গবেষকদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় তিনি বাগানটিতে বৃক্ষ লাগিয়েছিলেন সুপরিকল্পিতভাবে। তিনি মারা যান ২০০৫ সনে। তার স্বপ্নের সেই বাগানটি এখন দেশ বিদেশের সৌন্দর্য্য পিয়াসী মানুষের বিশেষ পছন্দ আকর্ষণের স্থানে পরিণত হয়েছে। গত চার বছর ধরে বাগানে ফুল ফোটছে। বসন্তে শিমুল বাগানটি যৌবন ফিরে পায়। তাছাড়া ফুল ফোটার আগেও সারি সারি বৃক্ষতলে এসে সময় কাটান সৌন্দর্য্য পিয়াসীরা। বসসন্ত দিনে বৃক্ষ সারির সবুজাভ পথ ধরে প্রিয়ার হাত ধরে পথ হাটেন প্রেমিকের দঙ্গল। ফুল ফোটার এমন ক্ষণে এখন আর কেউ বসে নেই। প্রতিদিনই হাজির হচ্ছেন শিমুল বাগানটিতে। তারা দেখছেন আকাশের নীলাভ ক্যানভাসে লালরঙের নাচন, সরু ডালে পাখির ওড়াওড়ি। রূপের নদী যাদুকাটায় ঝলমলে জল। সবুজ পাহাড়ে শাদা মেঘের দৌঁড়।
তাহিরপুর সীমান্তের দুর্গম গ্রাম মানিগাঁও। পাহাড়-নদী ঘেরা এমন একটি স্থানে সারি সারি শিমুল গাছ দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায়ও প্রকৃতিপ্রেমিদের নেই। শিমুলের মুগ্ধতায় মাতাতে স্থানীয় কয়েকটি ট্যুরিস্ট দল ইতোমধ্যে জোছনারাতে ক্যাম্প করার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকর্ষণীয় ছবি দিয়ে ভ্রমণার্থীদের টানছেন তারা। এর সঙ্গে স্থানীয় উঠতি যুবকেরাও প্রতিদিন শিমুলের থোকা থোকা ফুল দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব করে চলছেন। শিমুল বাগানের সারি সারি গোলাকার গাছ, চিকন ডাল, ন্যাড়া মাথায় ঝুলে থাকা ফুলগুলো এখন এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে রেখেছে। বিষন্ন মানুষও শিমুলের রঙে উজ্জ্বল করছেন দেহমন। আজ বসন্তের প্রথম দিনে বাগান কর্তৃপক্ষ আনন্দ গানের উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রয়াত জয়নাল আবেদীনের স্বজনরা জানান, হাজী জয়নাল আবেদিন ছিলেন একসময় জেলার শীর্ষ জলমহাল ব্যবসায়ী। তার নিয়ন্ত্রিত টাঙ্গুয়ার হাওরটি একদা হাতছাড়া হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পরিকল্পিতভাবে মৎস্য আহরণ করে হাওরটিকে তিনি মাদার ফিশারিজে পরিণত করেছিলেন। হঠাৎ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি বিষন্ন মন নিয়ে ব্যতিক্রমী অন্য কিছু ভাবছিলেন। ফালগুন মাসের একদিন বাড়ি থেকে মানিগাও গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। গ্রামটির দুই দিকে সীমান্ত নদী মাহরাম ও যাদুকাটা। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় চরগুলো দেখতে মরুময় বালুভূমির মতো। এসময় তিনি দেখলেন, মাহরাম নদীর কিনারে তিনটি লম্বাটে শিমুল গাছ। আগুনরাঙ্গা ফুলগুলো খুব সুন্দর। তার বিষণœ মন ভালো হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক চিন্তা করেন দেশের সর্ববৃহৎ শিমুল বাগান তৈরি করবেন তিনি। ফুলে ফুলে সুশোভিত করবেন চারপাশ। মৌতাতে মাতাবেন মানুষ ও প্রকৃতিকে। এই ভাবনা থেকেই এখানে জায়গা কিনতে শুরু করলেন। কিনতে কিনতে প্রায় ৩৩ একর জমি কিনে ফেললেন। জমি কেনা শেষ হলে তিনি বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পরিবেশ সচেতন মানুষ ও নার্সারি মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিকল্পিত একটি শিমুল বাগান করার চিন্তার কথা জানান। শুরু হয় বাগান তৈরি কাজ। মাটিতে হাঁটু সমান সারি সারি গর্ত করতে থাকেন রোজ কামলা দিয়ে। রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সেই কাজ তদারকি করেন তিনি নিজেই। গর্তে দেওয়া হয় গোবরসহ বিভিন্ন প্রজাতির সার। এক সঙ্গে লাগানো হয় প্রায় দুই হাজার শিমুল গাছ। গাছের নিচে সেচ দিতে বাগানে একটি নলকুপও বসান। স্ট্যান্ড বানিয়ে বিরাট একটি পানির টেংকি বসিয়ে চারা লাগানোর পর সেচ দেওয়া শুরু করেন। সেই বৃক্ষগুলোতে তিনি উপস্থিত থেকে নিয়মিত সেচ দিয়ে গাছগুলোকে সতেজ জীবনে ফেরান। তার স্বপ্নের ডালপালাও বাড়তে তাকে। প্রাথমিক এই বাগান করতে গিয়ে তার প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছিল বলে স্বজনা জানিয়েছেন।
তার পরিবারের লোকজন জানান, বাগান করার পর আরো নানা পরিকল্পনা নিয়েছিলেন হাজী জয়নাল আবেদিন। বাগানের পাশের বড়গোপ টিলা, (বারেকের টিলা) মেঘালয় পাহাড় ও রূপের নদী যাদুকাটার সৌন্দর্য্যকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিত একটি ছোট রিসোর্ট করার পরিকল্পনাও ছিল। তার সেই স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি। ঢাকা থেকে ফেরার পথে ২০০৫ সনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এই বৃক্ষপ্রেমিক ও শিক্ষানুরাগী মানুষটি। তিনি মারা গেলেও তার মনের সৌন্দর্যের খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে আসা মানুষজন যখন হিজল করচের বাগানে হারিয়ে যান, রঙলাগা শিমুল বাগানে প্রবেশ করেন তখন তাঁর বৃক্ষপ্রেমের কারণে তাকে অতল শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেন না তারা। বেড়াতে এসে মানুষজন তার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার কথা জানাচ্ছেন।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, একদশক আগেও সীমান্ত গ্রাম মানিগাও দুর্গম ছিল। মানুষজন তেমন আসতে পারতেন না। তাই বাগানটিও দৃষ্টির আড়ালেই ছিল বাইরের মানুষের। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও সরাসরি মোটর সাইকেল ছাড়া গাড়ি নিয়ে বাগানে যাওয়ার সুযোগ নেই। শিমুল বাগানটির পশ্চিমে এক সময়ের ভেঙ্গে যাওয়া মাহরাম গ্রাম। উত্তরে ভরাট হয়ে যাওয়া শীর্ণ মাহরাম নদী ও বড়গোপ টিলা (বারেকের টিলা এবং খাসিয়া পাহাড়। বাগানটির নিচেই খাসিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী যাদুকাটা। প্রকৃতিসুন্দর এমন অনন্য স্থানে গড়ে ওঠা বাগানটিকে আরো বিশিষ্ট করে তুলেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বাগানের স্বত্তাধিকারীরা জানান, গত চার বছর ধরে পুরোদমে ফুল ফুটতে শুরু করেছে বাগানে। প্রত্যক্ষর্শীদের মতে একসঙ্গে আড়াই হাজার বাগানে ফুল ফুটলে দূর থেকে বাগানের উপরকে ধোয়াহীন আগুন মনে হয়। ফুল ফোটার কল্যাণে বাগানের সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দৃষ্টিনন্দন ছবিগুলোর মুগ্ধতায় মজে এখন অনেকেই শিমুল বাগানে আসতে শুরু করেছেন। বাগানের সারি সারি বৃক্ষের নিচে পড়ে থাকে ফুলের ঝরা কলিগুলো প্রতিদিনই পড়ে। ঘুরতে আসা অনেককেই এই ঝরাফুল দিয়ে সবুজ ভূমিতে আল্পনা আঁকতে দেখা যায়। অনেকে মনের সুখে বাগানের সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে আড্ডাও দেন। বাগানে এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসছেন পর্যটকরা। আজকের বসন্ত দিনে বাগানে মানুষের ভিড় বাড়বে বলে মনে করছেন স্বত্তাধিকারীরা।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের শিক্ষার্থী খালেদ হাসান তার সঙ্গে বন্ধু রোমান, নিশু, তিষাসহ কয়েকজন মিলে এসেছেন। তারা নিচে পড়ে যাওয়া ফুলগুলো কুড়িয়ে দুর্বাঘাসের ক্যানভাসে একটি গীটারের অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সঙ্গীরা সারি সারি বসে খুনসুটিও করছিলেন। খালেদ জানালেন, এমন সুন্দর একটি স্থানে এসে মনটি ভালো হয়ে যায়। এমন সুন্দর রঙিন প্রকৃতি বিষন্ন মনের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। তিনি বলেন, প্রকৃতির এই সুন্দর স্থানটিতে এসে আমি শুধু শিমুলেই মন রাঙাইনি পাশের পাহাড় ও সুন্দর যাদুকাটা নদীটিও আমাদের মুগ্ধ করেছে। কলেজ ছাত্রী ত্বিষা জানান, গত চার বছর ধরেই সপরিবারে এখানে ঘুরতে আসি আমরা। আমাদের দূরের বন্ধু বান্ধবরাও যোগ দেয় রঙিন উৎসবে। আমরা বেড়াতে এসে বাগানের নিচে পড়ে থাকা ফুল কুড়াই, আনন্দ করি। উৎফুল্ল মনে বাড়ি ফিরি। তবে বাগানে দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা ও বাথরুমের ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।
জয়নাল আবেদিনের কন্যা জেলা পরিষদ সদস্য সেলিনা আবেদীন বলেন, আমার বাবাকে জেলার সব মানুষ বৃক্ষপেমিক হিসেবে চিনে। বাবা বড় শখ করে বাগানটি করেছিলেন। বাগানটি ফুল ফোটার আগেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। প্রকৃতিকে সুন্দর ও মানুষের জন্য বাসযোগ্য করতে তিনি দুই যুগ আগে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এখন বলা যায় তার সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে। মানুষ বাগানটি দেখে আনন্দের সঙ্গে আমাদের বাবাকেও মনে করছে। আমরা বাগানটিকে ঘিরে মানুষের বসার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করছি। কিছু পরিকল্পান নিচ্ছি যাতে মানুষ একটু আরামে বসতে পারে। তাছাড়া আজ বিশেষ আনন্দ গানের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগানটি আমাদের উপজেলার নাম উজ্জ্বল করেছে। বাগানে ফুল ফোটার এই মওসুমে দেশ বিদেশ থেকে মানুষজন আসছেন। আমরা উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ঘুরতে আসা মানুষজনকে বসার ও তাদের বাথরুমের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা চিন্তা করছি।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!