বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জ জেলায় মৎস্য আহরণের এই মওসুমে চলছে ২০ একরের নিচের জলমহালগুলোতে জলমহাল শুকিয়ে মৎস্য আহরণের মহোৎসব। ছোট জলমহালগুলো শ্যালু মেশিনে পানি শুকিয়ে মাছ ধরতে সুবিদার কারণে বরাবরই ইজারাদার শুকিয়ে মৎস্য আহরণ করেন। মৎস্য অফিস, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পরও নীরব থাকে। যার ফলে জলমহাল শুকিয়ে মৎস্য আহরণ থামানো যাচ্ছেনা। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় কৃষক, পরিবেশ সংগঠন সোচ্চার হলেও প্রশাসনিক সহায়তায় ইজারাদার তাদের বিরুদ্ধে সাতধারায় মামলাসহ জলমহাল লুটপাটের মামলা দিয়ে হয়রানি করে। স্বাধীনতার পর থেকেই এটা চলছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০ একরের নিচের জলমহালগুলো যেগুলো উপজেলা প্রশাসন ইজারা দিয়ে থাকে জেলায় এরকম জলমহাল রয়েছে ৬২৫টি। এগুলো বেশিরভাগই তিন বছর মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়ে থাকে। কিছু জলমহাল প্রশাসন ও ইজারাদারের যোগসাজসে দখল নিয়ে আদালতে মামলাধীন রয়েছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন, প্রশাসনিক দফতরে পাঠানো অভিযোগ থেকে জানা গেছে এবারও বরাবরের মতো জলমহাল শুকিয়ে মৎস্য আহরণ করা হচ্ছে। অভিযোগ থেকে জানা গেছে দোয়ারাবাজার উপজেলার সিঙ্গির দাইর, সদর উপজেলার নলদিঘা বান্দেরকোণা গ্রুপ জলমহাল, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে বাইঞ্চাখাউড়ি গজারিয়া জলমহাল, একই উপজেলার বগলার ডুবি জলমহালে শ্যালু মেশিন লাগিয়ে মৎস্য আহরণ করেছে ইজারাদার। জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী শুকিয়ে মাছ ধরার নিয়ম না থাকলেও সেটাই করছে ইজারাদাররা। এদিকে স্থানীয় কৃষক ও পরিবেশ কর্মী ও কৃষকরা জলমহাল শুকিয়ে মৎস্য আহরণের অভিযোগ করায় উল্টো তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে থাকে ইজারাদার। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় এই মামলা দেয় ইজারারদার ও তাদের লোকজন। এদিকে প্রশাসনের সংশিষ্ট দুর্নীতিবাজদের সহায়তায় সম্প্রতি ইজারাদারের লোকজন অভিনব এক পদ্দতি বের করেছে। তারা ভাড়াটে কৃষক দেখিয়ে জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে মর্মে শ্যালু মেশিন লাগিয়ে প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করছে। এদিকে কৃষকরা বলছেন, সুনামগঞ্জের হাওরের বোরো জমিতে অতীতে কখনো শ্যালু মেশিনে পানি সেচ দিতে হয়না। স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে একই স্থানে একাধিক শ্যালু মেশিনে পানি সেচের প্রমাণ পেয়ে প্রতিবেদন দিলেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়না বলে অভিযোগ আছে। পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন বর্ষা মওসুমে মাছের পোনা নিধনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। তারা দাবি জানিয়েছেন মৎস্য আহরণের শুস্ক মওসুমে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনার। এতে আগ্রাসী ইজারাদারদের থামানো যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। দক্ষিণ সুনাসগঞ্জের বাইঞ্চাখাউড়ি গজারিয়া জলমহালটি স্বত্ত মামলায় জর্জগিত থাকার পরও ইজারাদার একাধিক শ্যালু মেশিনে পানি শুকিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেওয়ায় স্থানীয় এক কৃষক উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিস তদন্তে গিয়ে সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দিলেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা। সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের নলদিঘা বান্দেরকোণা গ্রুপ জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরার প্রমাণের প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আক্কাস আলী। কিন্তু উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর মৌজার বগলার ডুবি জলমহালের পানি শুকিয়ে মৎস্য আহরণে বাধা দেয়ায় স্থানীয় কৃষকদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মামলা দায়ের করেছে ইজারাদেরর লোকজন। স্থানীয় পাইকাপন মৎস্যজীবী সমিতির লোকজন নিজেদের সমিতির নামে ইজারা গ্রহণ করে সাবলিজ দিয়ে গ্রুপ জলমহালটি ব্যবস্থাপনা করে জলমহাল শুকিয়ে মৎস্য আহরণ করে আসায় প্রতিবাদ করছিলেন স্থানীয় কৃষকরা। চলতি জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে জলমহালটিতে পানি শুকিয়ে মৎস্য আহরণ না করতে জলমহালের আশপাশের জমির কৃষকরা বাধা দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছে ইজারাদার। মামলার কারণে কাউয়াজুরী গ্রামের ১৪ কৃষক এখন আতঙ্কে আছেন। গত বছর সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের নলদিঘা বান্দেরকোণা জলমহালটি অবৈধভাবে আহরণ করেও ক্ষান্ত ছিলনা অবৈধ আহরণে বাধা দেওয়ায় গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল অবৈধ ইজারাদার রেজা মিয়া। এভাবে অন্যান্য স্থানেও যারা মৎস্য আহরণের মওসুমে জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরায় বাধা দেয় তাদের বিরুদ্ধে হয়রাণিমূলক মামলা করে চলছে ইজারাদার ও তাদের লোকজন।
সুনামগঞ্জের পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি এডভোকেট শফিকুল আলম বলেন, আমাদের সুনামগঞ্জে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কারণেই হাওরের জমিতে মেশিনে সেচ দিতে হয়না। কুন্দ বা হেমইত দিয়ে অল্প জমিতে সেচ দেন কৃষক। এই মওসুমে ছোট জলমহালগুলো প্রশাসনের চোখের সামনেই একাধিক শ্যালু মেশিন লাগিয়ে প্রকৃতি বিনাশ করে মাছের বংশ নির্বংশ করে মাছ ধরে ইজারাদার। কেউ বাধা দিলে প্রশাসনের সহায়তায় উল্টো মামলা দিয়ে তাদের হয়রানী করে বলে আমরা অভিযোগ পাই। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এদের বিরুদ্ধে নাগরিক উদ্যোগ প্রয়োজন। নাহলে হাওর মৎস্যশুন্য হয়ে যাবে। তিনি বলেন, প্রশাসন বর্ষা মওসুমে মৎস্য আহরণের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা না করে শুষ্ক মওসুমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা উচিত।
জেলা মৎস্য অফিসার মো. আমিনুল হক বলেন, মৎস্য আহরণে কোন অনিয়ম বা প্রকৃতিবিনাশী কাজ হয়ে তাকলে স্থানীয় প্রশাসন দেখভাল করার কথা। আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে আমার তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করতে পারি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, জলমহাল শুকিয়ে মাছ আহরণের কোন সুযোগ নেই। প্রকৃতি বিনাশী এই কাজ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।