দিরাই প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধলের সবুজ মাঠে কাল বুধবার বসছে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী ‘ধল মেলা’। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। হিন্দু ধর্মলম্বীদের ধর্মী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এ মেলার আয়োজন হলেও ‘ধল মেলা’ যেন সমগ্র ভাটি অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম জনতার সম্প্রীতির মিলন মেলায় পরিণত হয়ে উঠে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হবেনা বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির সদস্য দুলন চৌধুরী। ধল মেলার সঠিক ইতিহাস কারও জানা নেই। তবে মেলার উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মত চালু রয়েছে। হিন্দুরা একটি শিলাকে তাদের জাগ্রত দেবী ‘পরমেশ্বরী’ মনে করে পূজা করতে শুরু করে। তারা এ শিলাটিকে দুধ খাওয়ায়। তাদের ভাষ্য এ শিলাটির গায়ে যত দুধই ঢালা ্হউকনা কেন শিলারূপি দেবী সব খেয়ে নেন। প্রতি বছর তারা ভেড়া বলিদান করে মাতা পরমেশ্বরীর উদ্দেশ্যে। এই রীতি আস্তে আস্তে আশ-পাশের গ্রাম গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় দূর-দূরান্তের হিন্দু লোকেরাও পূজা করার উদ্দেশ্যে এখানে আসতে শুরু করেন। নানা আয়োজনে ধল মেলা হয়ে উঠতো বৃহৎ ও প্রাণবন্ত। মেলার উৎপত্তি নিয়ে এমন বক্তব্যেও সাথে দ্বিমত পোষনও করেন অনেকে। প্রাচীন এ মেলার উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস সকলেরই অজ্ঞাত। এই উৎসবকে বুকে ধারন করে বেড়ে উঠা এক চারন কবি বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম। স্ব-শিক্ষিত কবির বেড়ে উঠার পেছনে ছিল ধল মেলার ঐতিহ্য। তবে ধল গ্রাম – করিমের গ্রাম এবং করিমের সৃষ্টি ও কীর্তিকে ঘিরে শিল্পী-কুশলী এবং হাজারো ভক্ত অনুরাগীরা নানা আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একুশে পদক প্রাপ্ত প্রয়াত বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম ধল মেলাকে নিয়ে অনেক গান রচনা করেছেন। যেমন তার রচিত-‘পয়লা ফাল্গুনে আইলো ধলের মেলা,/যাও যদি আও দলে দলে, উঠছে বেলা/যাইতে মেলা বাজারে রাস্তাতে নদী পড়ে/আগে যারা রাস্তা ধরে,যায় বড় ভালা/দেখবে কত সার্কাস বাজি, দেখলে মন হয় যে রাজি। হাতে যদি তাকে পুঁজি খাবে রসগোল্লা/এই করিমের পয়সা নাই, রসগোলঅøা খ্ াবা না খাই, রস বিলাইতে আমি যাই ওগো সরলা।’ হিন্দু-মুসলিম জনতার সম্প্রীতির মিলন মেলা ‘ধল মেলা’ এর পটভুমি নিয়ে শাহ আবদুল করিমের বিখ্যাত গান রচনা করেছেন ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান গাটু গান গাইতাম।
ধল মেলার ঐতিহ্যবাহীপণ্য কুইয়ারও বেল। মেলায় এসে লোকজন আর কিছু কিনুক আর নাই কিনুক অন্ততঃ একআটি কুইয়ার ও এক হালি বেল কিনবেই। তা না হলে যেনো মেলায় যাওয়ার কোনো স্বার্থকতাই নেই। ধল মেলার মিষ্টি, রসমালাইর কদরও খুব বেশী। মেলা উপলক্ষ্যে গ্রামের ঘরে ঘরে চিড়া তৈরী করা হয়। সামর্থ অনুযায়ী কেউ ৪/৫মণ ধানের খই, চিড়াও তৈরী করেছে। মেলা উপলক্ষ্যে বেড়াতে আসা আত্মীয় স্বজনদের খই, চিড়া দিয়ে আপ্যায়ন একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে।
পাকা উঁচু স্থানে রক্ষিত শিলাকে ঘিরে প্রায় ১৫ একর অনাবাদী জমিতে মেলা বসে। আগে এই স্থানের পরিধি আরও ব্যাপক ছিল। দিন দিন জমি আবাদী হয়ে যাওয়ায় মেলার জায়গা ছোট হয়ে আসছে।
ধল মেলার নির্ধারিত কোনো তারিখ নেই। তবে দিনটি নির্ধারিত আছে ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার। মূলত সোমবার থেকেই শুরু হয় মেলার প্রস্তুতি। মঙ্গল বার বিকেলে কিছুটা কেনা কাটা হয়। বুধবারে সকাল ১১টায় পূজায় ভেড়া বলিদানের মধ্যে শুরু হয়েছে মূল মেলা। স্থানীয় ভাবে বলা হয় মঙ্গল বারে আধা মেলা , আর বুধবারে পুরা মেলা । লাঠি, কুইয়ার, বেল ধল মেলার ঐতিহ্য। এছাড়াও স্থানীয় ভাবে আবহমান গ্রামবাংলার তৈরী বাশঁ , বেত ও মাটির পণ্য এবং দৈনন্দিন কাজে লাগে এমন পণ্যের প্রায় সহস্রাধীক দোকান বসে মেলায়। অশ্লীলতা পরিহার করে মেলায় যাত্রা এবং সার্কাসসহ বিভিন্ন ধরনের গ্রামীন খেলার আযোজন ্করবেন এমন প্রত্যাশা এলাকাবাসির আয়োজকদের কাছে ।