হাওর ডেস্ক::
বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে কমান্ডো অভিযানে নিহত পলাশ আহমেদ নামের এক যুবক এখন সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রে, তার পরিচয় জানতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে বিচিত্র সব তথ্য।
মাদ্রাসা পড়ুয়া পলাশ ‘কবর’ নামের একটি সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ২৪ বছর বয়সী এই তরুণ বিয়ে করেছেন দুই দফা।
তার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী শামসুর নাহার শিমলা। মাস তিনেক আগে তাদের সেই সম্পর্ক চুকেবুকে যায়।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের দুধঘাটা এলাকার পিয়ার জাহান সরদারের ছেলে পলাশ বাবার টাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে। বাবার ভাষায়, পলাশ তার ‘অবাধ্য’ সন্তান।
বিদেশে পাঠানোর কথা বলে এলাকার মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, এমনকি ‘অপহৃত হওয়ার নাটক করে’ নিজের বাবার কাছ থেকে টাকা আদায়ের মত ঘটনাও পলাশ ঘটিয়েছেন।
আর র্যাবের ক্রিমিনাল ডেটাবেইজে পলাশের নাম রয়েছে একজন অপরাধী হিসেবে। ২০১২ সালে একটি অপহরণ মামলায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর ১৫ দিন।
সাবেক স্ত্রী শিমলার পরিবারের অভিযোগ আরও গুরুতর। তারা বলছেন, পলাশের সঙ্গে বিভিন্ন ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীর’ নিয়মিত ওঠাবসা ছিল।
তবে একেবারে শেষ দিকে হঠাৎ করেই পলাশের ধর্মে মতি হয়েছিল বলে তার পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য।
মাহাদী-মাহিবি-পলাশ
ঢাকা থেকে ১৪৮ জন যাত্রী নিয়ে রোববার বিকালে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজ। চট্টগ্রাম হয়ে রাতেই দুবাই পৌঁছানোর কথা ছিল উড়োজাহাজটির।
কিন্তু সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণের পরপরই ফ্লাইট বিজি-১৪৭ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ জানায়, অস্ত্রধারী এক যুবক বিমানটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ততক্ষণে বিমানটি ঘিরে ফেলে। যাত্রীদের সবাইকে নামিয়েও আনা হয়।
প্রায় দুই ঘণ্টা টান টান উত্তেজনার পর আট মিনিটের কমান্ডো অভিযানে জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে। সেনা ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, পিস্তলধারী ওই যুবক নিহত হয়েছেন।
সে সময় তারা বলেছিলেন, নিহত যুবক নিজেকে ‘মাহাদী’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। পাইলটের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে তিনি ‘স্ত্রীর বিষয়ে’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।
এরপর সোমবার র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিহত যুবকের আঙুলের ছাপ তাদের ক্রিমিনাল ডেটাবেইজে থাকা এক অপরাধীর সঙ্গে মিলে গেছে। সে অনুযায়ী তার নাম হল মো. পলাশ আহমেদ, বাড়ি নারায়ণগঞ্জে।
অবশ্য এটাই পলাশের শেষ পরিচয় নয়। গতবছর বিভিন্ন পত্রিকায় খবর আসে, নিজের চেয়ে ২০ বছরের ছোট এক তরুণকে বিয়ে করেছেন চিত্রনায়িকা শিমলা। তার বরের নাম মাহিবি জাহান।
সোমবার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, সেই মাহিবিই বিমান ছিনতাইকাণ্ডের পলাশ। ওই নামেই ঢাকার সিনেমা পাড়ার কেউ কেউ তাকে চেনে।
মাহিবি জাহানের ফেইসবুকে নায়িকা শিমলার সঙ্গে প্রচুর ছবি দেওয়া রয়েছে। প্রোফাইলে লেখা হয়েছে, মাহিবি একজন আইটি বিজনেস অ্যানালিস্ট, কাজ করেছেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে। তার বাড়ি ঢাকায়, পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে, থাকেন যুক্তরাজ্যে।
ফুফাতো ভাই মো. ইব্রাহিম জানান, মাহিবি জাহান নামের ওই ফেইসবুক আইডি পলাশের। তবে প্রোফাইলের তথ্যগুলো সঠিক নয়।
ফেইসবুকে ওই পেইজে ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর পিস্তলসহ নিজের একটি ছবি দিয়েছিলেন পলাশ ওরফে মাহিবি।
রোববার বেলা ১টা তিন মিনিটে তার সর্বশেষ পোস্টে শুধু লেখা ছিল- “ঘৃণা নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।”
এর কয়েক ঘণ্টা পর বিমানের ফ্লাইটটি চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়।
‘দুবাই যাচ্ছি’
র্যাব বিমান ছিনতাইকারীর পরিচয় প্রকাশ করার পর সাংবাদিকসহ স্থানীয় অনেকেই ভিড় করছেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের পিরিজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামে পলাশদের বাড়িতে।
তার বাবা পিয়ার জাহান সরদার এক সময় সৌদি আরবে ছিলেন। দেশে ফিরে এসে এখন মুদি ব্যবসা করেন। তার চার সন্তানের মধ্যে পলাশই একমাত্র ছেলে।
রোববার রাতে পুলিশ একটি ছবি নিয়ে এসে জানতে চায় সেটা তার ছেলের ছবি কীনা। ছবি দেখে নিজের ছেলেকে শনাক্ত করেন পিয়ার জাহান। পরে পুলিশ পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালায়।
পিয়ার জাহান বলেন, বেশির ভাগ সময় পলাশ ঢাকাতেই থাকতেন। সেখানে তিনি কী করতেন, কোথায় থাকতেন, সে বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই।
“মাঝে মাঝে বাড়ি আসত, টাকা নিয়ে আবার চলে যেত। ঢাকায় গান আর অভিনয় করত বলে এলাকায় বলত। দুইবার ওকে মালয়েশিয়া আর দুবাই পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রচুর টাকা পয়সা নষ্ট করে দেশে ফিরে আসছে।”
গত শুক্রবার দুবাই যাওয়ার কথা বলে ঢাকার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন পলাশ। যাওয়ার সময় বাবার কাছ থেকে চেয়ে ১১ হাজার টাকা নিয়ে যান।
পিয়ার জাহান বলেন, “এবার ঢাকা যাওয়ার আগে টানা ২৫ দিন বাড়িতেই ছিল। ইদানিং নামাজ-কালাম পড়া শুরু করেছিল। আগে কখনও এ রকম দেখিনি।”
স্ট্রোক হওয়ায় বেশ কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে রোববারই বাড়ি ফিরেছেন পলাশের মা রেনু বেগম। ছেলের খবর পেয়ে আবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
পলাশ কেন বিমান ছিনতাই করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই পরিবারের সদস্যদের। তার বাবা বলেছেন, এত কাণ্ডের পর তিনি ছেলের লাশও আনতে যাবেন না।
“যে ছেলে এত বড় একটা জঘন্য কাণ্ড করতে পারে তার লাশ বহন করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।”
‘বখাটে’
দূর সম্পর্কের চাচা দ্বীন ইসলাম জানান, ২০১১ সালে সোনারগাঁওয়ের তাহেরপুর ইসলামিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন পলাশ। কিন্তু পড়া শেষ না করেই যান ঢাকায়।
পিরোজপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের (দুধঘাটা) সদস্য মো. মজিবুর রহমান ভূইয়ার ভাষায়, পিয়ার জাহান সরদারের ছেলে পলাশ খানিকটা ‘বখাটে ধরনের’।
“মাস দুই আগে পিয়ার জাহান আমাকে বলেছে, ছেলেটা কথাবার্তা কিচ্ছু শোনে না। পলাশ একাধিকার নিজেই অপহরণের নাটক সাজিয়ে তার বাবার কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করেছে। ছেলের আচরণ আর কাজে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ওর বাবা।”
ইউপি সদস্য মজিবুর বলেন, বিদেশে পাঠানোর কথা বলে এলাকার বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন পলাশ। কিন্তু কাউকে পাঠায়নি। পরে তার বাবাকে সেই টাকা শোধ করতে হয়েছে।
কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পলাশের সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না- সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি মজিবুর। তবে চিত্রজগতে পলাশের আনাগোনার খবর তিনিও পেয়েছেন।
“সে নায়িকা শিমলাকে নাকি বিয়ে করেছিল। স্থানীয় মানুষদের কাছে সে এভাবেই পরিচয় দিত।”
শিমলা পর্ব
গত বছর শুরুর দিকে শিমলা নামের একটি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে যান পলাশ। কয়েকদিন থেকে তারা আবার ঢাকায় ফিরে যায়। পলাশের পরিবার জানতে পারে, শিমলা নামের মেয়েটি সিনেমার নায়িকা।
দুই মাস পর শিমলাকে নিয়ে আবার বাড়িতে যান পলাশ। বাবা-মাকে জানান, তারা বিয়ে করেছেন।
“আমি মেয়েটিকে বলেছি আমার ছেলেকে যেন বুঝিয়ে শুনিয়ে ভালো করে। ছোট বেলা থেকেই সে কথাবার্তা শোনে না, আমি প্রবাসে থেকে যা আয় করেছি সে সবকিছু নিজের মত করে খরচ করে দেশ-বিদেশ ঘুরে-বেড়িয়েছে।”
শিমলার আগে মেঘলা নামে বগুড়ার এক মেয়ের সঙ্গে পলাশের প্রথম বিয়ে হয়। সেই স্ত্রীর সঙ্গেও তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। প্রথম স্ত্রীর ঘরে পলাশের একটি ছেলে রয়েছে বলে জানান পিয়ার জাহান।
বিচ্ছেদ
চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য শিমলা মুম্বাইয়ে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তবে শিমলার চাচাতো ভাই আব্দুর রহমান মিল্টন বলেছেন, পলাশের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি সত্যি, মাস তিনেক আগে তাদের বিচ্ছেদও হয়ে গেছে।
“আজ সকালে শিমলার ভাই ভুট্টো মিয়ার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি বলেছেন, শিমলা ভালো আছেন। উনি কোনো টেনশন করছেন না। কারণ সে (পলাশ) এখন আর তার স্বামী না।”
শিমলার মা জোৎস্না বেগমের বরাত দিয়ে মিল্টন বলেন, “পলাশের সঙ্গে বিভিন্ন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নিয়মিত ওঠাবসা ছিল। বিষয়টি জানতে পেরেই শিমলা পারিবারিকভাবে বিচ্ছেদের মাধ্যমে সেই সম্পর্ক থেকে সরে আসে।”
গতবছর ৫ নভেম্বর পলাশ আহমেদের নামে তালাকের নোটিস পাঠান শিমলা। তালাকনামার তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৮ সালের ৬ মার্চ।
তালাকের কারণ হিসেবে ‘দাম্পত্যজীবনে সুখী হতে না পারা, মনের অমিল ও বনিবনা না হওয়া, পারিবারিক অশান্তি এবং মানসিক নির্যাতনের’ কথা উল্লেখ করেছেন এই চিত্রনায়িকা।
দাম্পত্যজীবনে টানাপড়ের মধ্যে কয়েকমাস কলকাতায় কাটিয়ে এখন মুম্বাইয়ে থাকছেন ১৯৯৯ সালে ‘ম্যাডাম ফুলি’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া শিমলা। সবশেষ গতবছর ঈদুল আজহায় ঝিনাইদহের শৈলকূপায় গ্রামের বাড়িতে ফিরে তিনি উট কোরবানি দেন।
কবর
দুই বছর আগে চলচ্চিত্র পরিচালক রাশিদ পলাশের পরিচালনায় ‘কবর’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন পলাশ। তবে সহকর্মীরা তাকে চেনেন মাহিবি জাহান নামে।
রাশিদ পলাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চলচ্চিত্র শিল্পীদের আড্ডায় মাহিবির সঙ্গে তার পরিচয়। তবে পলাশ কি করতেন, কোথা থেকে এসেছেন, এসব তিনি জানতেন না।
“কারওয়ান বাজারের ইটিভির গলিতে এক আড্ডায় উনি অভিনয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বন্ধুদের অনুরোধে আমি তাকে ‘কবর’ সিনেমায় নিই। এর বাইরে বিস্তারিত কিছু আমি জানি না।”
শিমলার মাধ্যমেই মাহিবির সঙ্গে পরিচয় কি না জানতে চাইলে, এ বিষয়ে আর কথা আগাননি রাশিদ পলাশ।
শেষ ‘প্রতারণা’
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সোমবার বিকালে নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পলাশের বিষয়ে তদন্তের কথা জানান।
তিনি বলেন, “পলাশ মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাস করে। পরে বাসা ছেড়ে চলে যায়। তার বাবা-চাচারা সবাই বিদেশে থাকত, খোঁজ খবর নেওয়ার মত কেউ ছিল না। সে বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান ছিল।”
স্থানীয়দের কাছ থেকে পলাশের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “সে বহুদিন নিজের কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করত না। বাসায় এলে বোনের মোবাইল ফোন ব্যবহার করত।
“যতটুকু জানা গেছে, এবারও সে বিদেশে নেওয়ার কথা বলে কিছু লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। তবে মামলা বা প্রতারণার কোনো লিখিত অভিযোগ থানায় আমরা পাইনি। ঢাকায় সে কারো সাথে কিছু করেছে কি না, তা আমাদের জানা নেই।”
(সৌজন্যে বিডিনিউজ)।