বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জে নৌ-পথে বালু পাথর বাহি নৌকা থেকে চাঁদাবাজির দ্বন্ধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হাতে মিজানুর রহমান (২৫) নামক এক যুবক খুনের ঘটনায় আট জনকে থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
বৃহস্পতিবারের ওই হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের সহোদর বড়ভাই জুনেদ মিয়া ওরফে জুনায়েদ ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে ওই রাতেই সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
নিহত মিজানুর রহমান সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ্ইব্রাহিমপুরের গ্রামের মৃত আবদুর রহিমের ছেলে।
প্রসঙ্গত: বৃহস্পতিবার সকাল ৭ টার দিকে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অক্ষয় নগর গ্রামের খালের তীরে ওই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটিয়ে প্রতিপক্ষের দুবৃক্তরা লাশ ফেলে রেখে চলে যায়।
প্রতিপক্ষের দুবৃত্তরা ধারালো রামদা দিয়ে মিজানুরকে কুপিয়ে তার এক হাত কেটে ফেলে অপর হাতের কব্জি ও কেটে ফেলে। দু’হাত ছাড়াও শরিরের বিভিন্ন স্থানে রামদা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মিজানুরকে খুন করা হয়।
ঘটনার পরপর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় নিহতের বড়ভাই জুনেদ মিয়া ওরফে জুনায়েদ গণমাধ্যম ও থানা পুলিশকে জানান, সদর উপজেলার সদরগড় গ্রামের মসজিদের নামে প্রতিদিনের ন্যায় বালু -পাথর বাহি ষ্টিলবাডি নৌকা থেকে টাকা (চাঁদা) কালেকশান করতে গ্রামের বাড়ি ইব্রাহীমপুর থেকে মিজানুর রহমান তার অপর দুই সহযোগীর একজন সম্পর্কে রেজা উদ্দিন ওরফে রেজাউল ও অপর আরো একজনকে সাথে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রতিবেশী গ্রাম অক্ষয় নগরের খালের মুখে যান।
পরবর্তী সদর উপজেলার একই ইউনিয়নের সদরগড় গ্রামে ইয়াবা সহ একাধিক মামলার আসামী নজরুল ইসলাম ওরফে নুর জামান ওরফে নইদ্যার নেতৃত্বে প্রতিপক্ষের চাঁদা আদায়কারী গ্রুপের ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দুবৃত্তের দল মিজানুরকে টাকা কালেকশানে বাঁধা প্রদান করে। প্রতিপক্ষের লোকজন নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নৌ-পথে চাঁদা আদায়ের জের ধরে প্রথমে মারধর করার এক পর্যায়ে পরবর্তীতে ধারালো রামদা দিয়ে কুপিয়ে মিজানুরের লাশ খালের মুখেই ফেলে রেখে যায় । এ সময় প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়ে মিজানুরের মামা রেজাউলও আহত হন।
খবর পেয়ে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ ওইদিন সকাল পৌনে ১০টায় ঘটনাস্থলে পৌছে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীর পর লাশ জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
নিহত মিজানুরের ভাই ও মামলার বাদী জুনেদ মিয়া পরবর্তীতে দাবি করেন তার ভাই নৌ পথে মসজিদের নামে টাকা কালেকশান করলেও সে বালু পাথর পোর্ল্টি ফার্মের ব্যবসার সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন।
ঘটনার সম্পর্কে নৌ-পথে চলাচলকারী নৌযানের একাধিক মালিক, বালু পাথর ব্যবসায়ী ও এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন জানান, মুলত বৃহস্পতিবার শহর ঘেষা সুরমার নদীর উত্তরপাড়ের ধোপাজান চলতি নদীর পূর্বপাড়ে পূর্ব সদরগড় এলাকায় বালু মহালে চাঁদাবাজি নিয়ে পূর্ব বিরোধের জের ধরেই মিজানুর রহমান নামের ওই যুবক খুন হয়েছেন।
পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সুত্র ও এলাকাবাসী আরো জানান, মুলত হত্যাকান্ডের শিকার ও হত্যাকারী দুটি পক্ষই নৌ-পথে চাঁদাবাজির ঘাট নিয়ন্ত্রন নেয়ার দ্বন্ধের জেল ধরে ওই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তারা আরো জানান, ধোপাজান বালু পাথর মহালে বাংলাদেশ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিটিএ), সুরমা ইউনিয়ন ট্যাক্স, চলতি নদী উজানভাটি, এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ( মসজিদ-মাদ্রাসা) সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের রশিদে বালু-পাথর বহনকারী বাল্কহেড, কার্গো, ইঞ্জিন চালিত ট্রলার এবং বারকী শ্রমিকদের নিকট থেকে নামে বেনামে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। নদীর বাঁকে বাঁকে, গ্রামে-গ্রামে রয়েছে চাঁদা আদায়কারি সংঘবদ্ধ গ্রুপ।
জেলা শহরের একাধিক প্রভাবশালী মহলের আর্শীবাদ পৃষ্ঠ হয়ে নৌ -পথে চাঁদাবাজির এই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জেলা শহরের তেঘরিয়া, জেলা শহর ঘেষা অলিরবাজার ও পশ্চিম সদরগড়ের কিছু যুবককের সাথে ইব্রাহিমপুর ও পূর্ব সদরগড়ের কিছু যুবকের পুরনো বিরোধ রয়েছে।
ওই বিরোধের জের ধরে বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিপক্ষের ১০-১২ জনের ধারালো অস্ত্রের আক্রমণে খুন হন মিজানুর রহমান। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মিজানের এক হাত কেটে নেওয়া হয়। অন্য হাতের কব্জি কাটা হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপানো হয় তাকে। এসময় মিজানের সঙ্গে থাকা তার মামা ও ব্যবসায়িক পার্টনার রেজা উদ্দিন আহত হন।
পুলিশ এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত থাকায় তাৎক্ষণিক ভাবে ও বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে সদর উপজেলার সদরগড় গ্রামের মৃত আবদুল হেকিমের ছেলে নজরুল ইসলাম ওরফে নুর জামাল ওরফে নইদ্যা একই গ্রামের, হাজি মাছিম আলীর ছেলে আবদুল হাই , গুলজার আহমদের ছেলে ছাত্তার হোসেন, শেরগুল আলীর ছেলে কামাল মিয়া, রেনু মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম, জমির আলীর ছেলে আবুল কালাম,্্র ইব্রাহিমপুর গ্রামের মৃত সজ্জাদ আলীর ছেলে আব্দুল মালেক, আবদুল মান্নানের ছেলে আলী আনোয়ার সহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়।
আহত রেজা উদ্দিন জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৭ টায় আমার ভাগ্না মিজানুর আমাকে ফোন দিয়ে নদীর পাড়ের আব্দুন নূরের চায়ের দোকানে নিয়ে গেলে ওখানেই নদীতে নানা নামে নানা রশিদে টাকা আদায়কারী পশ্চিম সদরগড়ের নূর জামাল ওরফে নইদ্যা, আব্দুন নূর, রোকন মিয়া, খোকন মিয়া ও তেঘরিয়ার বশির আহমদ সহ ১০ থেকে ১২ জন চা ষ্টলে ঢুকে প্রথমে আমার মাথায় ঘুষি মারে। চা ষ্টল থেকে আমরা সরে যাওয়ার চেষ্টা করে বের হবার পরই প্রতিপক্ষের লোকজন দা, রামদা নিয়ে ফের হামলার করে। জন্য অগ্রসর হতে দেখে আমরা পালানোর জন্য দৌঁড় দেই। আমি সাঁতার কেটে নদীর পূর্বপাড়ে আসার চেষ্টা করি ওই সময়েই মিজানুরকে প্রতিপক্ষের লোকজন এলোপাতাড়ি কুপিয়ে বর্বরভাবে খুন করে।
মসজিদের নামে টাকা কালেকশানের বিষয়ে নিহত মিজানের ভাই জুনেদ গণমাধ্যকে বলেন,‘আমার ভাই ব্যবসায়ী, সে চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত নয়। গ্রামের জামে মসজিদের পক্ষ থেকে মিজানুর সহ কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ধোপাজান বালু পাথর মহাল থেকে মসজিদের সহায়তার অর্থ তুলতে। বৃহস্পতিবারও নদীতে মসজিদের অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল মিজানুর।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছাত্তার বলেন,‘আমরা নদী থেকে টোল আদায়ের জন্য কোন ইজারা দেইনি। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের নামে রশিদ ব্যবহার করে নৌ পথে চাঁদা আদায় যদি কেউ করে সেটি চাঁদাবাজি হিসাবেই গণ্য হবে। তবে কেন তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি।
শুক্রবার সন্ধায় সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. শহীদুল্লাহ্ বলেন,‘ঘটনায় জড়িত ৮ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তিনি আরো বলেন প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছে এবং যে যুবক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে মুলত দুই পক্ষই বিভিন্ন রশিদে ধোপাজান বা সুরমা নদীতে বালু পাথর বাহি নৌকা ট্রলার, বারকি নৌকা, বাল্ক হেট, কার্গো ও জাহাজ থেকে চাঁদা তোলে।