ইকবাল কাগজী::
শিক্ষক ও তার বন্ধু মিলে ধর্ষণ করল ছাত্রীকে’। এটি গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম। তারপর ভেতরে কী আছে পড়ার কোনও দরকার নেই। বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা এমন হয়ে পড়েছে যে, যে-কেউ ভাবতে পারেন যে, দেশটি ধর্ষকের দেশে পরিণত হয়েছে। আসলে কি তাই? মোটেও তা নয়। দেশের আর্থনীতিক পরিপ্রেক্ষিতের বিন্যাসের একটু হেলদোল ঘটেছে বটে, গড় হিসেবে মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হয়েছে কিন্তু যৌনতার সামাজিক পরিস্থিতি একটু আধটু ব্যতিক্রম বাদে আগের মতোই আছে, সামন্তযুগে যেমন ছিল। অর্থাৎ সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার কোনও হেরফের হয়নি বলে ধর্ষণপ্রবণতাও অপরিবর্তিত আছে এবং জনসংখ্যার অনুপাতে ধর্ষণের সংখ্যাও সমানই আছে। আগেকার দিনে যেমন ও যে-হারে ধর্ষণ হতো একালেও তেমনি একই হারে ধর্ষণ হচ্ছে। কেবল আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বললে বুঝায় জনসংখ্যার অনুপাতে বেড়েছে এবং সেকাল একালে তুলনায় ধর্ষণপ্রবণতার কোনও হেরফের ঘটেনি, অপরিবর্তিত আছে। অর্থাৎ আগে ধর্ষণ কম হতো এখন বেশি হচ্ছে এমন ধারণা নিতান্তই অর্থহীন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেশে ধর্ষণ বেড়েছে বলে সাধারণভাবে ধারণা হতেই পারে। এর কারণ হলো ১৯৮০ সালে জনগণনা অনুসারে আমাদের দেশের জনসংখ্যা ছিল আট কোটি বর্তমানে সে-সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণাধিক হয়ে পড়েছে, সতেরো কোটির অধিক এবং সমাজে ধর্ষণের হোতা কিংবা নিয়ামকশক্তি পুরুষতান্ত্রিকতা আগের মতোই অপরিবর্তিত আছে। সুতরাং সমাজে ধর্ষণপ্রবণতা স্থির থাকলেও জনসংখ্যার অনুপাতে ১৯৮০ সালের তুলনায় বর্তমানে ধর্ষণের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে পড়েছে এবং অন্যদিকে সংবাদ সম্প্রচারের শক্তি ১৯৮০ এর তুলনায় শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উপর্যুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় যে, সেকাল একালের সার্বিক পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে : ধর্ষণপ্রবণতা যেমন ছিল তেমনই আছে, বাড়েনি মোটেও, বরং কমবেশি আগের মতোই আছে, অর্থাৎ আগে যেমন যে-হারে ধর্ষণ হতো বর্তমানেও তেমনিই সে-হারেই হচ্ছে, একটু আধটু রকমফের বাদে। ধর্ষণ সংঘটনের জন্য এখন জঙ্গল নেই বাগানবাড়িও নেই, আছে ভিড়ের মধ্যে সৃষ্ট আধুনিক নির্জনতা। আধুনিক নির্জনতার স্বরূপটি এমন যে, ধর্ষণ এবং ধর্ষণান্তে খুন পর্যন্ত ঘটছে চলন্ত বাসের ভেতর। বৈদ্যুতিন (ডিজিটালাইজ) যুগে খবরটা সঙ্গে সঙ্গে ছড়াচ্ছে বিশ্বের আনাচে কানাচে, বলতে গেলে সিংহভাগ ঘটনার প্রসঙ্গে লোকে জানতে পারছে। আগে সংঘটিত ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশের তো কোনও প্রশ্নই উঠে না, এখনকার তুলনায় গণমাধ্যম তো বলতে গেলে তখন নেই-ই, তাই তখন ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। অর্থাৎ বর্তমানে যে হারে ধর্ষণ হচ্ছে আগেকার দিনে ধর্ষণের হারটি তেমনই ছিল, অন্তত কম ছিল না, কেবল মানুষে জানতে পারার মাত্রাটা কম ছিল। ধর্ষণের ঘটনা জানার মাত্রা বেড়ে গেছে বলে মনে হয় ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে।
প্রকৃতপ্রস্তাবে বাংলাদেশে আগে যেমন ধর্ষণ হতো এখনও তেমনি ধর্ষণ হচ্ছে। আগেকার দিনে লোকে টেরই পেতো না, এখন বৈদ্যুতিন যুগে কেবল টের পায় এমন নয় বরং রীতিমতো ধাক্কা খায়। বাংলাদেশে ধর্ষণপরিস্থিতি আগে যেমন ছিল ব্যতিক্রম ছাড়া বর্তমানেও তেমনই আছে। কেবল স্বরূপটি অতীতে কম প্রকটিত হতো এবং বর্তমানে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকটিত হচ্ছে সবটুকু না হলেও উল্লেখযোগ্য হারে ও জনসংখ্যার স্ফীতির সমানুপাতিক হার সাপেক্ষে সংখ্যার বহরবিশালত্বে। ঘটনা প্রতিনিয়ত ছাপানো হচ্ছে গণমাধ্যমের পরতে পরতে, এমনকি সেটা সম্প্রচারিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নিমিষেই সংবাদ পৌঁছে যাচ্ছে কানে কানে, জনে জনে। আলোচিত হচ্ছে ধর্ষিত মেয়েটির কথা। যে-হার ও গতিতে প্রচার হচ্ছে সে-হার ও গতিতে বিচার পাচ্ছে না ধর্ষিতারা। পুরুষতান্ত্রিকতার এই অবিমৃষ্যকারিতার নির্মূল না ঘটলে অবস্থা অপরিবর্তিতই থাকবে। নারী ধর্ষিত হতেই থাকবে, কোনও প্রতিকার মিলবে না। পরিশেষে বলার কথা এই যে, সম্পূর্ণরূপে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা কখনওই সম্ভব হবে না। সেটা সম্ভব কেবল তখনই যখন নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্য নির্মূল করা সম্ভব হবে। সেটা অসম্ভব। কিন্তু প্রায় নির্মূলের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হলে বর্তমান সমাজটাকে পাল্টে দিয়ে নারীপুরুষের সামাজিক ক্ষমতায়নে সমতা আনয়ন করতে হবে। তাহলেই বদলাবে পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে উদ্ভূত সমাজমানসতা, যা পুরুষের মনে উদ্ভূত ধর্ষণপ্রবণতার মূল কারণ। ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে হলে পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক মনের পরিবর্তন অবশ্যই চাই, এর কোনও বিকল্প নেই।
(ইকবাল কাগজী, কবি, সাংবাদিক ও গবেষক)।