একটা মালা নেন না ভাইয়া একটা মালা…। সারা দেশ ও রাজধানী ঢাকায় যখন তীব্র তাপদাহে জন জীবন অতিষ্ট হয়ে চরম পর্যায়ে তখন অনেকেই একটু প্রশান্তির জন্য যানজট আর লোকালয় ছেড়ে রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলিতে ছুটে আসেন সকল কর্মবেস্থতা ফেলে রেখে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক তিনটা বাজে। রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে অনেক লোকজন, কেউবা শার্ট খুলে, গেঞ্জি গায়ে কোন গাছের ছায়াতলে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউবা বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে এসে জোড়ায় জোড়ায় বসে খোশ গল্প করছেন আর প্রকৃতির একটু শীতল বাতাস গায়ে মেখে নিজেকে ক্লেশ মুক্ত করছেন। আমি একা বসে আছি চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকের ধারে। সামনে এমপি হোস্টেল পিছনে উদ্যান মাঝখানে লেক। আকাশের বুক থেকে বাতাস এসে যখন গায়ে দোলা দেয় মনে হয় শীতাতপের চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ আরামের অনুভুতি অনুভব করছি। এমন সময় পাঁচ বছরের একটি কালো রঙের মায়াবী চেহারার ছোট্র শিশু কাছে এসে অনেক মিষ্টি সুরে বলছে ভাইয়া একটা মালা নেন না একটা মালা। গায়ের রঙ কালো হলেও মুখে একটা মায়াবী ভাব আমায় কিছুটা নাড়িয়ে দিলো। বললাম একটা মালার দাম কতো? বললো ভাইয়া পাঁচ টাকা দিলে দুইটা মালা দিবো। আমি বললাম আমি তো এখানে একা আসছি মালা নিয়ে কি করবো? হাসিমাখা মুখে হাসি দিয়ে বললো বাসায় গিয়ে ভাবির কালো চুলের খোপায় পড়িয়ে দিবেন ভাবী অনেক খুশী হবেন। আমি বললাম তাই নাকি? বললো হ্যা ভাইয়া। জিজ্ঞেস করলাম তুমি কিভাবে জানো? মালা পরালে ভাবী খুশি হবে। বললো অনেক ভাইয়া এখানে ভাবী নাহয় আপাকে নিয়ে আসে আমি মালা বিক্রি করি। ভাইয়া যখন ভাবী কিংবা আপার খোপায় মালা পরিয়ে দেয় তখন আপা অনেক খুশি হয়ে ভাইয়ার কানে কানে হেসে হেসে কি যেন বলে ভাইয়াও তখন হাসে। আমি বললাম ঠিক আছে মালার দাম কতো? হাসি দিয়ে বললো দুইটা পাঁচ টাকা আর একটা গোলাপ দশ টাকা। আমি বললাম ঠিক আছে মালা নিবোনা এমনিতেই যদি তুমাকে বিশ টাকা দেই তোমার কেমন লাগবে? আবারো মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো অনেক ভাল লাগবে আমি অনেক খুশি হবো। তবে মালা আপনাকে নিতে হবে এমনি এমনি টাকা নিবনা। আমি বললাম আমার বাড়ীতো অনেক দূর মালা নিয়ে বাড়ী যেতে যেতে নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মালা নিবনা তুমি টাকা নিয়ে যাও। বললো না ভাইয়া তাহলে আমি আপনার গলায় মালা পরিয়ে দিবো। আমি বললাম ঠিক আছে তাহলে। মালাটা হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে অনেক ক্ষন মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মালাটা পরিয়ে দিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম এভাবে আমার দিকে চেয়ে থেকে কি দেখছো? বললো ভাইয়া আপনাকে দেখে অনেক ভাল লাগছে তাই একটু ভাল করে দেখে নিলাম। আমার বুকের ভেতরটায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা মৃদু ভুমিকম্প বয়ে গেলো। মনের অজান্তেই দো’চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভাবতে লাগলাম এখানে এসে কতো লোক কতো টাকা খরচ করে। যে টাকাগুলি খরচ না করলেও কোন ক্ষতি হবেনা। আর এখানেই কোন ফুটফুটে শিশু ৫ টাকার মালা বিক্রি করার জন্য কতো কাকুতি মিনতি করে। হায়রে নিয়তি, হায়রে জীবন, যেখানে যেমন।
যে বয়সে একটি শিশুর পড়ালেখা করার কথা সেই বয়সে পড়ালেখা না করে শুধুমাত্র দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য দিক বিদিক ছুটে বেড়ায়। মালা পড়ানো শেষ হলে জিজ্ঞেস করলাম তুমার নাম কি, বাড়ি কোথায়, থাকো কই, আর কে আছে এখানে, মালা বিক্রি করে টাকা দিয়ে কি করো? আবারো মিষ্টি হাসি দিয়ে উত্তর দিলো আমার নাম ঝর্না, বাড়ী কিশোরগঞ্জ, মালা বিক্রি করে মার কাছে টাকা দেই সেই টাকা দিয়েই আমরা ভাত খাই, মাও রাস্তায় বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করেন। মানিব্যাগটা বের করে একটা নুতন পঞ্চাশ টাকার নোট ঝর্নার হাতে তুলে দিলাম আর অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে দেখলাম ওর চোখে, মুখে আনন্দের ছাপ। টাকাটা হাতে নিয়েই একটা লম্বা দৌড় আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা ক’ভাই বোন? দৌড়ের মধ্যেই উত্তর দিলো তিন বোন আমি ছোট। আমি ওর চলে যাওয়াটা দেখলাম যতো দূরো চোখ যায়। মিনিট দুয়েক দেখার পর ঝর্নাকে আর দেখা গেলনা। মনে মনে বললাম ভাল থেকো ঝর্না, বেঁচে থাকলে তোমার সাথে আবারো দেখা হবে এখানেই।
লেখক: সাজ্জাদ হোসেন শাহ্ (সাংবাদিক ও লেখক) তাহিরপুর, সুনামগঞ্জ।