বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা সীমান্ত গ্রাম কড়ইগড়া গ্রামের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ বিসেন্দ্র রিছিল (৬৩) আর নেই। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও ৬ ছেলে মেয়েসহ অসংখ্য আতœীয় স্বজন রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। আজ বিকেলে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননার মাধ্যমে ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে শেষ বিদায় জানানো হবে।
সুনামগঞ্জ জেলার শেষ সীমান্ত নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দার মধুকোড়া এলাকার আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের মুক্তিযোদ্ধা বীরেন্দ্র রিছিল। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারিক কারণে ১৯৭৯ সন থেকে তিনি বিয়ে করে স্থায়ী হন তাহিরপুরের কড়ইগড়া গ্রামে। ৬ সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তিনি তাহিরপুর সীমান্তে বসবাস করতেন। শিক্ষকতা করেছেন বাদাঘাট এলাকার শান্তিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দীর্ঘদিন কঠিন রোগে ভোগে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টায় মারা যান তিনি।
১৯৭১ সনে নবম শ্রেণি পড়–য়া একহারা গড়নের সরল আদিবাসী যুবক বীসেন্দ্র রিছিল এলাকার আদিবাসী বন্ধু সচিন হাজং, গজেন, মিনসন কুটি, এলবার্ট, ওয়ারকিং, সেভেন, অখিল, রনজিতসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তার সম্প্রদায়ের অন্যান্য তরুণরা যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল বীসেন্দ্র তখন বাঙ্গালি-আদিবাসী যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে নানাভাবে উজ্জীবিত করেই ক্ষান্ত হননি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
শারিরিক গড়নে ছোট হওয়ায় ১১নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং তালিকায় নাম লেখাতে বেগ পেতে হয় বীসেন্দ্রকে। তবে অদম্য ইচ্ছের কারণে অক্টোবর মাসে সেই সুযোগ পান তিনি। আদিবাসী হওয়ায় সহযোদ্ধাদের অনেকেই ট্রেনিং ক্যাম্পে তার ভাষা বুঝতো না। ফলে ট্রেনিং নিতে গিয়ে নানা সমস্যা হয় তাঁর। মেঘালয়ের গারো হিলস এলাকায় ২১দিন ট্রেনিং নিয়ে কোম্পানী কমান্ডার গোলাম আজম ও প্লাটুন কমান্ডার এনায়েতের অধীনে গেরিলা যুদ্ধে মাঠে নামেন। তবে শারিরিক গড়নে ছোট থাকায় ট্রেনিং ক্যাম্পে এলএমজি চলানো শেখানো হয়নি তাকে। ছোটখাটো গড়নের সুবিধা নিয়ে তাকে গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগানো হয়। বালকের বেশে ঘুরে ঘুরে রাজাকার ও পাক হায়েনাদের অবস্থানের তথ্য দিতেন তিনি। কলমা কান্দা থেকে নাজিরপুর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিতেন। রাতে অস্ত্র হাতে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গেরিলা যোদ্ধার রেকি করতেন।
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। দিন তারিখ মনে নেই অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা বীসেন্দ্রের। জানালেন, কলমাকান্দার নাজিরপুর এলাকায় পাঞ্জাবীরা বোমা ফেলে তাদের দলের উপর। তারা ওই এলাকার আমবাগানে তখন অ্যামবুশে ছিলেন। উচু নিচু এলাকার কারণে বোমাটি লক্ষ্যচ্যূত হওয়ায় রক্ষা পান বীসেন্দ্র রিছিল। পরে কলমাকান্দার দাইয়া এলাকায় সশস্ত্র রাজাকারদের সঙ্গে তাদের আরেকটি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরতর আহত হন। কয়েকজন রাজাকার মারা যায়। যুদ্ধ শেষে নেত্রকোনা সিটি কলেজ মাঠে অস্ত্র সমর্পণ করেন তিনি। তৎকালীন এসডিও তাকে টহলের কাজে লাগান। তিনমাস বাড়ি ফিরে আসেন বীসেন্দ্র। বাড়ি ফিরে দেখেন পোড়া বাড়িতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাই নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করতে চরম বেগ পেতে হয়েছে তার পরিবারের। তবে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার আনন্দে সেই দুঃখ ভুলেছিলেন তিনি। তার যুদ্ধকালীন সময়ে আশ্রয় কেন্দ্রে মারা যান মা ও বড় ভাবী।