প্রিয় মানুষ নিরঞ্জন। মানে উকিল নিরঞ্জন তালুকদারের ফোন। ভাবলাম সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থাৎ পত্রিকায় প্রকাশিত কোনও সংবাদ নিয়ে আলাপ আছে। কিন্তু ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নির্লিপ্ত উচ্চারণ, ‘মানিকদা মারা গেছেন।’
জানতাম দাদার অসুস্থতা বেড়েছে। আর এই অসুস্থতাটা একেবারে নতুন কীছু নয়। বেশ পুরনো। আমরা যারা জানি তারা সকলেই শঙ্কিত ছিলাম, কখন জানি কী হয়। যাঁরা মানিকদার কাছের মানুষ ছিলেন, এই সংবাদ তাঁদের কাছে কতটা মর্মান্তিক সেটা লিখে বুঝানোর বিষয় নয়। এই মৃত্যু সাধারণ কোনও মানুষের মৃত্যু নয়, একজন অসাধারণ বিপ্লবীর মৃত্যু। যে-অসাধারণ বিপ্লবীকে এই সমাজসংসার না চিনলেও পুঁজিবাদ ঠিকই চেনে এবং বেশি করেই চেনে ও চিনতো।
-কোন সময়?
-এই তো সকাল সাড়ে সাতটায়।
দাদার অন্তর্ধানের দিনটির নাম শুক্রবার। ২৬ জুলাই ২০১৯। সংবাদটি এতো তড়িঘড়ি করে পেয়ে যাব ভাবতে পারিনি। কম্পিউটারে প্রতিদিন লেখালেখি করি। তখন সবে সকাল ৯টা হয় তো হবে। এর মধ্যে ফোন। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর কীছু লিখবো না। আজ আমার ছুটি। মানিকদাকে শেষ দেখা দেখতে যাবো। গিয়ে দেখলাম দাদাকে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মুখটা ছাড়া সমস্ত শরীর চাদরে ঢাকা। মুখে কোনও কষ্টের চিহ্ন নেই। দাদা কেবল ঘুমিয়ে আছে। আমার কোনও কষ্ট হলো না। দাদাকে ঘিরে বসে বেশ ক’জন নারী। আমি কারও মুখের দিকে তাকালাম না। কান্নার মৃদুমন্দ স্বর কানে এলো। তাকাতেই বৌদির চিরসুকোমল মুখটা দেখতে পেলাম। এমন করুণ তাঁকে কখনো দেখিনি। কেন জানি কী একটা কষ্টে বুকটা কেমন করে উঠলো। নদীর পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পেলাম। তড়িঘড়ি দাদার পায়ের কাছ থেকে পালিয়ে এলাম বাইরের করিডোরের মতো একচিলতে উঠোনে।
তখন বৌদির বয়স বড়জোর তেরো কি চৌদ্দ। সেই বয়সেই বৌদির সঙ্গে দাদার বিয়ে হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরের ঘটনা। তৎকালের সুনামগঞ্জের একমাত্র সিনেমা হল নূরজাহানের পশ্চিমে লাগোয়া একটি বাসাতে বৌদিরা ভাড়া থাকতেন। সে বাসাতেই সামনের দিকের একটি ছোট কোঠায় ছিল দাদার বিছানা-আস্তানা। আমরা তখন যারা ‘আমরা কতিপয় সাহিত্যসেবী’ করতাম সেখানে তাঁদের হরদম যাতায়াত ছিল। দাদা ছিলেন ‘আমরা কতিপয় সাহিত্যসেবী’র সভাপতি। মুতাসিম আলী ছিলেন সম্পাদক। এই সংগঠনের সঙ্গে আরও যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা হলেন : জীয়ন কুমার দাস মিন্টু, অজিত কুমার দাস, মমিনুল মউজদীন, মোহাম্মদ সাদিক, আশরাফ আহমদ, হাসান আফরোজ, লুৎফার শামীম, তৃষ্ণা দাস, আমি ইকবাল কাগজী প্রমুখ। আমাদের বিখ্যাত সেই সময়ে পশ্চিম বাজার কামারখালের পূর্বপাড়ের একটি ঘরে দাদা একটি লাইব্রেরি দিয়ে ব্যবসায় শুরু করলেন। এই লাইব্রেরি ঘরের পেছনেই তিনি বৌদিকে নিয়ে থাকেন। সামনের লাইব্রেরিতে রাতদিন শত ছাত্রছাত্রীর আনাগোনা। সে এক অন্য ধরনের শিক্ষকতা। বলতে গেলে কেউই শিক্ষককে টিউশনির টাকা দেয় না। মাগনা পড়ে যায়। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেসব শিক্ষার্থীকে ঠেঙিয়ে মাধ্যমিকের দ্বার পার করাতে পারেননি মানিকদার কাছে তারা আসে যায় পড়ে, হেসে খেলে পাস করে সহজেই। আর একটি শিক্ষা পায় তারা এখানে। সেটা রাজনীতির শিক্ষা। এখানে তাঁরা একদিকে যেমন দক্ষ হয় গণিতে, বিজ্ঞানের কোনও শাখায় কিংবা ইংরেজিতে তেমনি অপরদিকে তারা জানতে পারে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাওয়ের নাম। তারা পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে পড়ে চীন-রাশিয়ার লাল বই। মাধ্যমিক পাস করার পাশাপাশি তারা শিখে ফেলে সা¤্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত, শ্রেণিশোষণ, শ্রেণিসংগ্রাম, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি রাজনীতিক অর্থনীতিক পরিভাষা পায় ভাববাদ, বস্তুবাদ পর্যন্ত, সে অনেক কীছু।
আমরা যারা তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম তাঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময় জানতে পারলাম আমাদের প্রত্যেকের পেছনে সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারি আছে। তখনই বোধোদয় হয়েছিল এই রাষ্ট্রব্যবস্থার লোকেরা আমাকে কিংবা মানিকদাকে মিত্র ভাবে না। আমি তাদের নিজের লোক নই। চোরের পেছনে নজরদারি না থাকলেও একজন রাজনীতি সচেতন মানিকলাল রায়ের পেছনে তারা পড়ে রয়েছে রাতদিন। কারণ তাদের চাই বশংবদ মানিক, যে তাদের জয়ধ্বনি করবে। আমি কোনও গোপন সাম্যবাদী দলের কেউ কখনওই হতে পারিনি। যদিও চলেছি তাদেরই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তখন জানতাম না। পরিণত বয়সে এসে এখন জানি মানিকদা বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর হয়ে কাজ করতেন। শেষ জীবনে তিনি অবশ্য রাজনীতি থেকে সরে থেকেছেন। কিন্তু কোনও ধরনের বিচ্যুতি তার জীবনে নেই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার মতাদর্শে অবিচল ছিলেন।
মানিকদা চলে গেলেন। কিন্তু যে সময়টা তিনি কাটিয়ে গেলেন সে-সময়টা বড়বেশি খতরনাক। সাধারণ মানুষের জন্য বড় বেশি নির্মম। সময়টার বর্ণনা করতে হলে বলতে হয় এখন কৃষকের ধানের দাম নেই। ধান চাষ করে কৃষক কোন লাভ পায় না। অথচ এই ধান কেনাতে একবার, বেচতে একবার, চাল বানানোতে একবার, চাল থেকে অন্যান্য উপউপাদান তৈরিতে একবার লাভ হয়, কেবল লাভ হয় না কৃষকের, কৃষকের কেবল লোকসান। এমনই সুবিধাবঞ্চিত জীবনসঙ্কটের মধ্যে চলছে কেবল কৃষকের নয় সারাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন। বর্তমানে সাধারণ মানুষরা যে-হারে শোষিত হচ্ছে সে-হারে এক শ্রেণির মানুষ ধনী হচ্ছে ক্রমাগত। বাংলাদেশ যেমন তেমনি বিশ্বজুড়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে। পুঁজিবাদ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে অস্ত্র ও কৌশলগুলোর প্রয়োগ করছে। যেভাবে পারছে সেভাবেই রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে, দমন পীড়ন চলছে দিকে দিকে। পুঁজিবাদ শত্রু হয়ে উঠেছে মানুষ, প্রকৃতি ও জীবের, এককথায় পৃথিবীর। এটাও একটা রাজনীতি। মুনাফার জন্য এই যে রাজনীতি, এই রাজনীতির বিরোধী রাজনীতি করতেন মানিকদা। সাধারণ মানুষের শোষণ নির্যাতন অবসানের রাজনীতি।
একটি কথা আছে, বামপন্থীই বামপন্থী নয়, যদি বিপ্লবী না হয়। মানিকদা বিপ্লবী অর্থে বামপন্থী। যদিও তার অনুসরণকৃত নীতি মানুষ গ্রহণ করেনি। কিন্তু বোধ করি সময় সমাগত মানুষকে মানিকদার নীতিটিই গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় মানবপ্রজাতির অস্তিত্বই থাকবে না, বিলীন হয়ে যাবে। আর তখন যদি মানিকদা ফিরে আসেন তবে হয় তো মন্তব্য করবেন, গাধা জল ঘোলা করে খায় (খায় স্থলে ‘পান করে’ পড়ুন)
(সৌজন্যে: সুনামকণ্ঠ)