বিশেষ প্রতিনিধি::
স্বাধীনতার জন্য চরম উদগ্রীব ও উজ্জীবিত সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার প্রত্যন্ত শ্রীরামসী গ্রামের সাধারণ মানুষ দাসত্বের শৃঙ্খল মেনে না নেওয়ার পণ নিয়ে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে জয় বাংলার স্লোগান দিয়েছিলেন। স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে এই খবর পেয়ে গ্রামবাসীকে শায়েস্তা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় হানাদার বাহিনী ও এ দেশীয় দোসররা। ১৯৭১ সনের ৩১ আগস্ট গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে শান্তি কমিটির সভা ডেকে পিছন থেকে হাতমোড়া করে বেঁধে ব্রাশ ফায়ারে ১২৬ জনকে হত্যা করেছিল। শান্তি কমিটির সভায় বিলম্বে উপস্থিতির তুচ্চ কারণ দেখিয়ে বাছাই করে গ্রামের বুদ্ধিজীবি, চাকুরিজিবী, তরুণ ও ছাত্রসহ সাধারণ জনতাকে কয়েক দফায় হত্যা করা হয়। নির্মম হত্যাকাণ্ড চালানোর পরে শ্রীমরামসী বাজার আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। একাত্তরের বিভিষীকাময় এই দিনটি স্মরণে শ্রীরামসী শহীদ স্মৃতি সংসদ আজ আলোচনাসভার আয়োজন করেছে। এই নিটির কথা মনে হলে এখনো কুকড়ে যান প্রত্যক্ষদর্শী ও গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, শ্রীরামসী গ্রামের নারকীয় হত্যার পিছনে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসরা কয়েকটি কারণে ক্ষুব্দ ছিল। ১৯৭০ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে টানানো তারকাখচিত পাকিস্তানী পতাকা গ্রামের যুবকেরা নিচে নামিয়ে পদদলিত করে স্বাধীন বাংলার স্লোগান দেন। এই খবরটি তখন স্থানীয় রাজারকার গোষ্টি পাকিস্তানী একশন সেলে লিপিবদ্ধ করায়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দু’জন রাজাকার শান্তি কমিটির হয়ে চাঁদা ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য এলাকায় এলে তাদেরকে গণপিঠুনি দিয়ে বিদায় করে এলাকাবাসী। এই খবরটিও দেওয়া হয় পাকিস্তানী বাহিনীকে। এদিকে পাকিস্তানী বাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এই এলাকাকে নিরাপদ ভেবে পার্শবর্তী এলাকার প্রায় শতাধিক হিন্দু নারী পুরুষ গ্রামে আশ্রয় নেন। এই খবরটিও পৌঁছে দেয় রাজাকাররা। এসব কারণে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী চরম ক্ষুব্দ ছিল শ্রীরামসি গ্রামবাসীর উপর। পাকিস্তানী দানবরা প্রথমে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিনকে লাঞ্চিত করেই বৈঠকে উপস্থিতিদের মধ্য থেকে দেরি করে উপস্থিতকারীদের ধড়পাকরের নির্দেশ দিয়ে এলোপাথারি মারধর শুরু করে। প্রথম দফায় প্রধান শিক্ষক, স্কুলের আরেক শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হাই, তহশিলদার, পোস্ট মাস্টারসহ ২৬ জনকে ব্রাশফায়ারের ফেলে। এদের মধ্যে ২৪ জন মারা যান। জোয়াহির চৌধুরী ও আলকাছ মিয়া নামের দুই কিশোর সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীতে নৌকায় তোলে আরো ৫০ জনকে এলোপাথারি গুলি করে হত্যা করে। যারা নৌকা থেকে প্রাণে রক্ষার জন্য পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তাদেরকেও উপরে তোলে পাখির মতো ফের গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছুক্ষণ পরে আরেকটু দূরে গিয়ে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আরো ৩০ জনকে হাত পা বেঁধে ব্রাশফায়ারের মুখে পাখির মতো গুলি করে মারে। এভাবে ইতিহাসের ন্যাক্করজনক গণহত্যা চালানো হয় হাওরাঞ্চলের দুর্গম এই গ্রামটিতে। কয়েক বছর আগে গ্রামবাসী শহিদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন। তবে শহিদদের স্মৃতি ও গণহস্থাস্থল সংরক্ষণের উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
শ্রীরামসি হত্যাকাণ্ডের বর্বর কাহিনীকে স্মরণ করে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে শহীদের নাম সংবলিত স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয় এবং ১৯৮৭ সালে শহীদ স্মৃতি সংসদ নামে একটি স্মৃতি সংসদ গঠিত হয়। স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে প্রতিবছর শহীদ স্মরণে আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। এ বছরও অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে বলে স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন। এবারের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান।
নামগঞ্জ মুক্তিয্দ্ধু পরিষদের নেতা মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর বলেন, হাওরাঞ্চলের ভয়াবহতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল শ্রীরামসীতে। এখনো তাদের স্মৃতি রক্ষার কোন উদ্যোগ নেই। তাছাড়া এই গণহত্যা সংগঠিতকারীদের অনেকে বেচে থাকলেও তাদের বিচারেরও কোন তৎপরতা নেই। শ্রীরামসী গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।