অনলাইন ডেক্স::
মিয়ানমারের মংডু খেয়ারি প্রাং এলাকায় নিজ বাড়ির সামনে মোহাম্মদ আলমের ছিল মুদি দোকান। আট সন্তানসহ তাঁর ১০ জনের পরিবারে অভাব ছিল না। সেনারা দোকানটি পুড়িয়ে দেওয়ার পর স্কুলপড়ুয়া তিন ছেলেসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তিনি। সামনের দিনগুলোতে কী হবে তিনি জানেন না।
বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারকে আলাদা করা নাফ নদ পাড়ি দিয়ে গত রবিবার মোহাম্মদ আলম কক্সবাজারের টেকনাফে এসে উঠেছেন।
আলমের মতো আরো অনেক রোহিঙ্গা মুসলমান রাতের অন্ধকারে কিংবা ভোর হওয়ার আগে আগে নৌকায় করে নদী পাড়ি দিয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে টেকনাফে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ দিন দিন বাড়ছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও কোস্ট গার্ডের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের প্রবেশ বাড়ছে। এতে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
টেকনাফ বিজিবি ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আবুজার আল জাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রাণপণে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করছি। এরপরে রাতের আঁধারে যদি ফাঁকফোকর গলিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটে, সেটা আমি বলতে পারব না।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার সীমান্তে নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরে ৩২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। পাশাপাশি অনিবন্ধিত আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম অবস্থান করছে কক্সবাজার-বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায়।
গত ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কয়েকটি ক্যাম্পে হামলায় ৯ বিজিপি সদস্য নিহত হয়। ওই সব ক্যাম্প থেকে লুট হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এর পরই ওই রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সরকার। ইতিমধ্যে ৬৯ জন রোহিঙ্গাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে সে দেশের সরকার। তবে সেখানে দুই শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা জানাচ্ছে। এ ছাড়া শত শত ঘরবাড়ি ও দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সহিংসতার শিকার শত শত রোহিঙ্গা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আশ্রয় নিচ্ছে বনাঞ্চল ও ধানক্ষেতে। দিনের বেলায় তারা লুকিয়ে থাকলেও রাতে নাফ নদ অতিক্রম করে টেকনাফ ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।
প্রাণরক্ষায় দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান রবিবার ভোরে টেকনাফে অনুপ্রবেশ করা আলম। তিনি জানান, তাঁর এক ছেলে রবি আলম স্থানীয় স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, আরেক ছেলে মোহাম্মদ রফিক প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। অন্য ছেলে মোহাম্মদ হারেস কেবল স্কুলে যেতে শুরু করেছে। লেদা অনিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া আলম এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে কী করবেন, সেটা ভেবেই উদ্বিগ্ন।
রাখাইন রাজ্যে ‘দুষ্কৃতকারী’র তালিকা হচ্ছে : ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানায়, মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী তাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে চায়। এ কারণেই নারী ও শিশুদের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রোহিঙ্গাদের। তারা বলছে, যেখানেই নারী-শিশু পাচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা, সেখানেই বর্বরতা চালাচ্ছে। গণধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে রোহিঙ্গারা তাদের নারীদের এপারে নিরাপদে এনে রাখছে। এমনই একজন রোহিঙ্গা ফয়েজ ইসলাম (৪৫)। নাফ নদের ওপারে কুয়ানচিবং গ্রামের এই বাসিন্দা দুই সপ্তাহ আগে তাঁর ১৭ বছরের কিশোরী মেয়েকে রাতের আঁধারে নদী পাড়ি দিয়ে নিয়ে আসেন। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া গ্রামের এক ঘনিষ্ঠজনের বাড়িতে মেয়েটিকে রেখে যান। গতকাল সোমবার সকালে তিনি রাখাইন রাজ্য থেকে গোপনে এসেছেন তাঁর মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে।
এর কারণ জানতে চাইলে ফয়েজ ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সেনাবাহিনীর লোকজনের গণধর্ষণ থেকে রক্ষার জন্য এপারে আমার মেয়েকে এনে রেখোছিলাম। কিন্তু এখন বাড়িতে মেয়ের উপস্থিতি দেখানোর তাগিদে আবার ফিরিয়ে নিতে এসেছি।’ তিনি আরো বলেন, যারা নির্যাতনের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়েছে তাদের তালিকা হচ্ছে। বাড়িতে যাদের না পাচ্ছে তাদেরই ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য নতুন করে জনগণনা শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। ফয়েজ ইসলাম বলেন, ‘পরিস্থিতি এমনই হয়ে উঠেছে যে রাখাইন জ্বলছে আর রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে।’
সীমান্তে পাচারকারী চক্র সক্রিয় : মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের বিশেষ করে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তের অন্তত ১৫টি স্থান দিয়ে মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিনে সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে জানা গেছে।
গতকাল সকাল ১০টায় কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং আমগাছতলা এলাকায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে দেখা যায়। সকালে টেকনাফের নয়াপাড়া, জিম্মনখালী, কাঞ্জরপাড়া, উনসি পেরাং এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে তারা।
আসার সময় মিয়ানমারের দালালদের দিতে হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশের দালালদের দিতে হয়েছে জনপ্রতি দুই হাজার টাকা। মংডুর খিয়ারিপাড়া গ্রামের মো. সেলিমের স্ত্রী তৈয়বা বেগম (২৫) এ কথা জানিয়েছেন। তিনি তাঁর পরিবারের অন্য সদস্য মোহাম্মদ আলম (৭), আহম্মদ হোছন (৩) ও মো. শফিককে (১৮ মাস) নিয়ে টেকনাফের নয়াপাড়া থেকে বাসে করে এসেছেন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য।
খিয়ারিপাড়ার আরেক বাসিন্দা মো. ইসলাম (৭২) জানান, সেনাবাহিনীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাঁচার জন্য তিনি তাঁর পরিবারের ৯ সদস্য নিয়ে গতকাল ভোরে এসে কুতুপালং বস্তি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ও রবিবার এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে।
এ ব্যাপারে কুতুপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বখতিয়ার আহম্মদ জানান, তিনি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের বিষয়টি জানিয়েছেন।
কুতুপালং অনিবন্ধিত শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবু সিদ্দিক জানান, রাতের বেলায়ই রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে বেশি।
এদিকে রবিবার রাতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশকালে নাফ নদে একটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় নারী, শিশুসহ ১০ জন নিখোঁজ হয়। গতকাল সন্ধ্যায় নাফ নদের তীর থেকে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে সীমান্ত এলাকায় যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে জন্য টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শফিউল আলম ও থানার ওসি আব্দুল মজিদ মানুষকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা গতকাল হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করে এ আহ্বান জানান।
কক্সবাজারে বিজিবি-বিজিপি পতাকা বৈঠক আগামীকাল : কক্সবাজারে আগামীকাল পতাকা বৈঠকে বসছেন বিজিবি ও বিজিপি কর্মকর্তারা। ওই দিন সকালে কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে এ সভা হওয়ার কথা রয়েছে। এতে মিয়ানমারের পক্ষে ২৫ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন বিজিপির একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেয়া থেনলুইন। আর বাংলাদেশের পক্ষে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন বিজিবির ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরিদ হাসান।
বৈঠকে কী কী বিষয় নিয়ে কথা হবে, সেটা স্পষ্টভাবে জানাননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, ইয়াবাসহ মাদক কারবার ও নাফ নদ থেকে বাংলাদেশি জেলে অপহরণের মতো বিষয়ে আলোচনা করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারে সামরিক সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে সে দেশের আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। এরপর বেশির ভাগ রোহিঙ্গা দেশে ফিরে গেলেও বর্তমানে নয়াপাড়া ও কুতুপালং ক্যাম্পে ৩২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এ ছাড়া কুতুপালং, লেদা ও মোছনী এলাকায় আরো দেড় লক্ষাধিক অনিবন্ধিত শরণার্থীসহ বান্দরবান ও কক্সবাজারে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।