‘ আপা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।’
খুব কাছ থেকে দেখেছি। জগ্ননাথ হলে তখন সুকোমল দার রুমে ফ্লোরিং করি। জিয়া হলে আমার এটাস্টেশন থাকলেও সীট না পেয়ে জগ্ননাথেই থাকি।
কিন্তু সুনামগঞ্জ থেকে আসা নেতৃবৃন্দের সাথে এই মিছিলে থাকার জন্যে আগের রাতেই চলে আসি হোটেলে।
সকাল ১০ টার দিকে ৯১, নবাবপুর থেকে আসা একটা বড় মিছিলে যোগ দেই। আওয়ামী লীগ অফিসের কাছে আসার আগেই আমাদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সবাই বিচ্ছিন্ন। দলা দলা মানুষ। চতুর্দিক মিছিল ছড়িয়ে পড়েছে। খুব সম্ভবত এর আগেই আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আসতে থাকা মিছিলে হামলা হয়েছিল তাই এখানে মানুষ আর জমায়েত হতে পারছে না। কিন্তু নবাবপুরের মোড় থেকে গুলিস্থান, গোলাপ শাহ মাজার, জিরো পয়েন্ট, স্টেডিয়াম গেইট, বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর দক্ষিন,জাসদ গলি সব জায়গায় খন্ড খন্ড মিছিল। মূলত সব মিছিলেই আওয়ামী লীগের অফিস কেন্দ্রিক। ঘুরে ঘুরে মিছিলের লোকজন আওয়ামী লীগ অফিসেই আসে। আবার অফিস থেকে আশে পাশের রাস্তায় চক্কর দেয়। মিছিল আসছে আর ঘুরছে। একজায়গায় দাঁড়ালেই ছত্রভংগ করে দিচ্ছে, পুলিশ জমায়েত হতে দিচ্ছে না।
মানুষ শুধু বাড়ছেই। শুনা যাচ্ছে নেত্রী আসবেন। কিন্তু কোন দিক থেকে আসবেন কিভাবে আসবেন কেউ জানে না। একটু পরে পরেই দৌড়ে মানুষ অফিসের দিকে যায়। আবার ছত্রভংগ হয়।
নবাবপুর থেকে আসা মিছিলের লোক ছিলাম আমরা। ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর কে কোন দল আর ঠিক নাই। জাসদ সিপিবি বাকশাল সবাই তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিলে ঘুরছে আওয়ামী লীগ অফিসকে সেন্টার করে। মূলত একটাই কথা শুনা যাচ্ছে, নেত্রী এলেই সমাবেশ হবে। এবং এই সমাবেশ থেকে সচিবালয়ের দিকে মিছিল হবে।
হঠাৎ দেখি একটি জীপে করে নেত্রী কই থেকে যেন এসেছেন, আর সাথে সাথে সব মিছিল একমুখী হয়ে গেছে। গগন বিদারী শ্লোগান। উল্কার মতো ছুটে আসছে মানুষ। কেঁপে উঠলো বঙ্গবন্ধু এভিনিউ।
আওয়ামী লীগ অফিসে নেত্রী আর যেতে পারেন নাই। স্টাডিয়ামের সামনে এখন যেখানে বঙ্গবন্ধুর মুরালটা আছে সেখানেই উনার গাড়ি আটকিয়ে হাজার হাজার মানুষের শ্লোগান।
জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো—-
জয় বাংলা —-
নেত্রী একটা হ্যান্ড মাইকে নিজেই শ্লোগান দিচ্ছেন।
সে এক উন্মাদনা। পাগলপারা।
আশেপাশের গলি থেকে মানুষ এসে জমায়েত হতে লাগলো। স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে জমায়েতের দিকে আমরাও এলাম।
এই সময় দেখি গায়ের শার্ট খুলে একটি লোক জয় বাংলা বলে শ্লোগান দিচ্ছে। তার বুকে পিঠে শ্লোগান লিখা,
‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক -স্বৈরাচার নিপাত যাক।’
সবাই তাকে ঘিরে জটলা পাকাচ্ছে।
লোকটা একেবারে নেত্রীর কাছেই চলে এসেছে।
নেত্রী তখন মাইকেই বললেন, এই তুমি শার্ট গায়ে দাও। তোমাকে তো মেরে ফেলবে।
সে তখন বলে উঠে,নেত্রী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
সে কাছে এগিয়ে গেল। শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত তখন পুরো এলাকা।
এর মধ্যে পুলিশের আক্রমণ। টিয়ার শেল। লাঠি চার্জ। আবারও ছত্রভঙ্গ। নেত্রীর গাড়িকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে।
ক্রেন এসে নেত্রীর গাড়িকে টো করে নিয়ে গেলো।
শেল ছোঁড়া হচ্ছে। অন্ধকার। গুলিও।
আমরা দৌড়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভিতরে ঢুকলাম। এখানে সুনামগঞ্জ থেকে আসা নেতারাও ছিলেন। খুব সম্ভবত হুমায়ুন ভাই, বাপ্টু দা, সুফিয়ান ভাই, আতম মিসবাহ ভাই, কাজল বরন সিংহ কয়েকজন একসাথে। এর মধ্যে জোহরের আযান পড়েছে।
সুফিয়ান ভাই বাপ্টুদাকে বলছেন, আমরা যা করি তুই তাই করবি। নামাজে খাড়া।
নামাজের মধ্যেই হুড়াহুড়ি। পুলিশ মাঝে মধ্যে বারান্দায় এসেও হামলা করছে।
নামাজের পরে দক্ষিন গেইটে এসে আমরা দেখি গেইট থেকে জিরো পয়েন্টের দিকে জিপিওর সামনে একটি ক্ষুদ্র মিছিল একটু পর পরেই পুলিশের দিকে যাচ্ছে, আর দাবড়ানি খেয়ে আবার পিছে হঠছে। আবার এগুচ্ছে আবার পিছনে আসছে। আর এই মিছিলটার শ্লোগান দিচ্ছে, এই শার্ট খোলা লোকটা।
ঝাকড়া চুল। শার্টটা খুলে মাঝে মাঝে নিশানের মতো মাথার উপরে ঘুরাচ্ছে আর আমাদেরকে মসজিদের ভিতর থেকে বের হয়ে আসার জন্যে ডাকছে।
পুলিশ গুলি করছে। সবাই দৌড়াদৌড়ি। সে শার্টটা কোমড়ে বেঁধে পুলিশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে একাই শ্লোগান দিচ্ছে।
দ্রুম দ্রুম দ্রুম। গুলি। ধোয়া। শেল। দৌড়াদৌড়ি। ছুটাছুটি।
বুক খোলা লোকটা পড়ে গেল মাটিতে। রক্তে লাল হলো জিরো পয়েন্ট। হলো ইতিহাস।
হলো কবিতা।
বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।
একটা আবেগের নাম।
নুর হোসেন।
স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনের এক মাইলফলক।
যারা নুর হোসেনকে ইয়াবাখোর বলেন, তাদের মুখে একদলা থু।