অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রতিক্ষার পর- বিভিন্ন মহলের মতামত, অনেক গবেষণা ও ব্যাপক আকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সবাই পেয়েছে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। যে প্রক্রিয়াটি ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হয় এবং পরবর্তীতে ২০১৮সালে গিয়ে আইনটি জাতীয় সংসদে এসে পাশ হয়। যে প্রক্রিয়ার মাঝে সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব বিশেষ করে সড়ক পরিবহন এবং মালিক শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিলো। তাদেরসহ সকলের মতামতের ভিত্তিতে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়।
আইনটি পাশ হবার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি গেজেটে সাক্ষরও করেন। কিন্তু আইনটি পাশ হওয়ার ১বছর সময় লেগে গেল প্রয়োগ করতে। তাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে। ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের আলোচনাসভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা দিলেন ১ নভেম্বর থেকে আইনটি বাস্তবায়ন করা হবে তখন জাতি আশার আলো দেখতে পেলো।
যুগ উপযোগী এই আইনটি পাশ হবার পর সাধারণ জনগণ ও সচেতন মহলের সকলে আইনের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর ১লা নভেম্বর থেকে হবার কথা থাকলেও আইন সম্পর্কে সকলে অবগত না থাকার কারণে ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়। আইন প্রযোগকারী সংস্থাসহ চালক, মালিক, যাত্রী, পথচারী সকলের মাঝে আইনের বিষয়ে যথেষ্ট ধারনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য। এরপর গত ৩দিন আগে থেকে যখন আইনটি প্রয়োগ শুরু হলো ঠিক সে সময় আমরা অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম চারদিকে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। আমার প্রশ্ন হলো, কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো?
অঘোষিত কর্মবিরতি চলার সময়ে বুধবার দুপুর থেকে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের কুশপুতুল বানিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড চত্বরে দাঁড় করিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখেন শ্রমিকরা
এইসব করে কি কোন কিছু রোধ করা যাবে? প্রতিবাদের ভাষা কি এসব হতে পারে? পৃথিবীতে যত বড় সমস্যাই হয়ে থাক তার সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে। তার জন্য সকল পক্ষ থেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আইনে কোন অসঙ্গতি থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে হবে। তাছাড়া আইনটি সবেমাত্র প্রয়োগ শুরু হয়েছে, কিছুদিন যাক এই আইনে কার কি সমস্যা দেখা দিচ্ছে বা কার কি ক্ষতি হচ্ছে সেটি আগে দেখুন, এরপর আইনের সঙ্গতি অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলুন। তা না করে কোন ক্ষতি না হবার আগেই ভয় পেয়ে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে, চারদিকে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে- তা সত্যিই দু:খজনক এবং এই অস্থিতিশীল পরিবেশ আমরা সচেতন নারগিক হিসেবে কেউ কামনা করিনা।
সর্বোপরি নিরাপদ সড়ক চাই দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে, সড়ককে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন ও দাবি পেশ করে যাচ্ছে। নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ নিরাপদ সড়ক চাই এর একক প্রচেষ্টায় আসেনি। এটা ঠিক দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই আইনের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। এই আইনটি সকল শ্রেণী, পেশা দলমত নির্বিশেষে জনসাধারনসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত একটি আইন।
কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে এই আইনটি কার্যকর হবার পর বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে হেনস্তা করা হচ্ছে। যা অতীতেও করা হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এই আইনটি করা হয়েছে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য, সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য। জেল বা জরিমানা আদায়ের জন্য নয়। কাউকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে নয়। যদি আপনারা এই আইন সঠিকভাবে মেনে চলেন তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আর যদি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেই আসে তাহলে আইনে জরিমানার ভয় কিসের? আপনি অপরাধ করলেন আপনার জেল জরিমানা হবে। আপনি যদি অপরাধ না করেন তাহলে কেন আপনার জেল জরিমানা হবে? আমি বুঝতে পারছিনা নিজেদের সংশোধন না করে, সঠিক লাইসেন্স না নিয়ে, দক্ষতা অর্জন না করে, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস না নিয়ে উল্টো জেল-জরিমানার কথা বলে জনগণকে জিম্মি করে কেন অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে? অথচ একটু ধৈর্য্য ধরে আইনের ভেতরে গিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই আইনটিতে কাউকে এককভাবে দায়ী বা টার্গেট করা হয়নি। বিশেষ করে চালকশ্রেনীকে নয়। বরং তাদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি, কর্মঘন্টা নির্ধারণ, নিয়োগপত্রসহ গাড়ি চালনায় সঠিক পরিবেশ তৈরির কথাও রয়েছে। তবুও কেন এই বিরোধিতা, কেন এই আইনকে মেনে না নিতে পারার মানসিকতা?
এরপরও যারা না বুঝে এই বিষয়টি নিয়ে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি করে জনসাধারনের ভোগান্তি বাড়াচ্ছেন তারা আশা করি নিজেদের ভুলগুলো বুঝে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। সেই সাথে আমি জনসাধারণের প্রতি আহবান জানাই। আপনারা শুরু থেকে এই আইনের প্রতি স্বত:স্ফুর্তভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। আজ পরিবহন সেক্টরের কিছু মানুষের নৈরাজ্যের কারণে আপনাদের ভোগান্তি হচ্ছে। তবে আমি মনে করি এই ভোগান্তি সাময়িক। দীর্ঘ সমাধানের জন্য আপনারা সাময়িক ভোগান্তি মেনে নিয়ে দেশে নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় সকলে এগিয়ে আসবেন বলে আমি আশা করি।
আমরা দীর্ঘ ৯মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে একটি দেশ স্বাধীন করেছি। ভালো কিছু অর্জন করতে হলে সাময়িক ভোগান্তি হয়তো আমাদের সহ্য করতে হবে। ধৈর্য্যহারা হবেন না। আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছবই।
আমি মনে করি নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি যদি কোন মহলের চাপের মুখে ব্যহত হয় এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হয় তাহলে আমরা যে দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি তা হয়তো আর বাস্তবায়ন হবেনা। পূর্বে যা ছিলো অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল আর অসহায় পরিবারের কান্না চলতেই থাকবে। তাই আমি মনে করি, এই আইনের সঠিক প্রয়োগে ও বাস্তবায়নে যদি হেরে যাই তাহলে হেরে যাবে বাংলাদেশ।