দৈনিক যুগান্তর::
সুনামগঞ্জের গণপূর্ত বিভাগে চলছে অনিয়মের মচ্ছব। কোটি কোটি টাকার কাজ দেয়া হচ্ছে যাচাই-বাছাই না করেই। নিয়মনীতিরও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে বাদ যাচ্ছে না মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও। এর মধ্যে ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদে পছন্দের দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকার কাজ। খোদ নির্বাহী প্রকৌশলীকে কেন্দ্র করেই দুর্নীতিবাজ একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে শাল্লায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের মূল ভবনের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ করে তুলে নেয়া হয়েছে পুরো টাকা। ভুয়া সনদে মেসার্স ইভান এন্টারপ্রাইজ প্রায় ২৩ কোটি টাকা এবং মেসার্স সূচনা ট্রেডিং প্রায় ৩ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সুনামগঞ্জের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গণপূর্ত অধিদফতর সুনামগঞ্জ ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর ১ কোটি ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে তাহিরপুর কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পায় ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদধারী মেসার্স সূচনা ট্রেডিং। কাজ বাগিয়ে নিতে সূচনা ট্রেডিং অভিজ্ঞতার যে সনদ জমা দেয় সেখানে শাল্লা উপজেলায় প্রাইমারি শিক্ষা উন্নয়ন প্রোগ্রাম (পিইডিপি) প্রকল্পের অধীনে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত ক্লাসরুম ও ফার্নিচার সরবরাহের কাজ করার কথা উল্লেখ করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পিইডিপি’র ওই কাজগুলো করেছে মেসার্স রাজিয়া কনস্ট্রাকশন।
বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন এলজিইডি সুনামগঞ্জের এক শীর্ষ কর্মকর্তাও। তিনি জানান, মেসার্স সূচনা ট্রেডিং নামের কোনো প্রতিষ্ঠান সুনামগঞ্জ এলজিইডিতে কোনো কাজ করেনি।
মেসার্স রাজিয়া কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী ফয়েজ আহমদ যুগান্তরকে বলেছেন, শাল্লার পিইডিপি প্রকল্পের ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত ক্লাসরুম ও ফার্নিচার সরবরাহের কাজ রাজিয়া কনস্ট্রাকশন একাই করেছে। অন্য কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল না। এখানেই শেষ নয়, প্রায় ২ কোটি ৬১ লাখ ৬৯ টাকা ব্যয়ে গত ৩ মার্চ সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটের দোতলা প্রিন্সিপাল কোয়ার্টার ও ১১ জুলাই তিন তলার স্টাফ ডরমেটরি নির্মাণের কাজও দেয়া হয়েছে ওই একই প্রতিষ্ঠানকে। মেসার্স সূচনা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী সাইদুজ্জামান সাইদুল ভুয়া সনদের কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে ভুয়া সনদের প্রমাণাদি দাখিল করলে বিষয়টি তিনি স্বীকার করে নেন।
অভিজ্ঞতার ভুয়া সনদ দেখিয়ে মেসার্স ইভান এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে প্রায় ২৩ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে গত ১৩ মে দোয়ারাবাজার উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র এবং গত ৩০ এপ্রিল বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
প্রতিষ্ঠানটি অভিজ্ঞতার সনদে ২০১৭ সালের ৯ জুলাই ঢাকায় শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৪৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পটি যে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করেছেন তার মধ্যে মেসার্স ইভান এন্টারপ্রাইজের নাম নেই। গণপূর্ত বিভাগের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, হাসান অ্যান্ড সন্স, মাসুদ অ্যান্ড সন্স, পদ্মা অ্যাসোসিয়েট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, দি ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড আর্কিটেক, এনডিই, জামাল কোম্পানি লিমিডেট ও এনডিই নামের এই ৭টি প্রতিষ্ঠানই প্রকল্পের কাজ করেছে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেসার্স ইভান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জুবায়ের ইসলাম প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, গণপূর্ত অধিদফতর শেরেবাংলা নগরের অনেক কাজই করেছি। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন টেন্ডারের জন্য অভিজ্ঞতা সনদ দাখিল করেছি। কোনটায় কোন কাজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছি তা না দেখে বলতে পারব না। কোথাও ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে আবারও প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ট্রেনে আছি। পরে কথা বলব।
অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার এখানেই শেষ নয়। গণপূর্ত বিভাগের অধীনে সুনামগঞ্জের শাল্লায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কাজের মেয়াদ এক বছর আগে শেষ হলেও এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৬০ ভাগ। অথচ প্রায় পুরো বিল পরিশোধ করা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আকতার ট্রেডার্সকে।
শাল্লা উপজেলা সদরের গোবিন্দ চন্দ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কাজ শুরু করে সিলেটের মেসার্স আকতার ট্রেডার্স। ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এরই মধ্যে প্রায় পুরো টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। বাকি কাজ এখন সুনামগঞ্জের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নিজেই করছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ভবনটি দেখলে মনে হয়, এটি কোনো পুরাকীর্তি। শাল্লা উপজেলা সদরের ব্যবসায়ী বিপ্লব রায় বলেন, এটির নির্মাণ কাজ এক বছর আগে শেষ হওয়ার কথা। এখন চলছে দায়সারাভাবে। উপজেলার যুবলীগ নেতা হুমায়ুন আহমেদ বলেন, ‘সুনামগঞ্জের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে শুনেছি ঠিকাদার শতভাগ বিলও তুলে নিয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। মাত্র ৪০% কাজ হয়েছে। কাজ না করে টাকা কীভাবে উত্তোলন করেছেন?
এ ব্যাপারে মেসার্স আক্তার ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জামাল চৌধুরীর মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। গণপূর্ত বিভাগের শাল্লায় দায়িত্বরত সহকারী প্রকৌশলী আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘শাল্লায় বছরে বেশির ভাগ সময় পানি থাকে। তাই কাজ করতে সমস্যা হয়। তবে নির্ধারিত সময় পার হলেও এখনও অনেক কাজ বাকি। শুধু ভবনের কাজ ৮০ ভাগের মতো শেষ হয়েছে।
জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগ সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবিল আয়াম বলেন, ‘মেসার্স সূচনা ট্রেডিং ও মেসার্স ইভান এন্টারপ্রাইজের ‘অভিজ্ঞতা সনদ’ যাচাই-বাছাই করে সঠিক বলে নিশ্চিত করেছেন দায়িত্বশীলরা। তারপরই তাদের কাজ দেয়া হয়েছে। শাল্লা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ৭০-৮০ পার্সেন্ট কাজ শেষ হয়েছে। অসমাপ্ত কাজ শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। ঠিকাদারকে পুরো বিল পরিশোধ করা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে আমি কমিশন গ্রহণ করিনি। এ অভিযোগ মিথ্যা। ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদে কাজ পাওয়ার সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই।
(সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর)