অনলাইন ডেক্স::
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান দমনপীড়নকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীকে আবারও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি মনে করছে, সেনাবাহিনী দিয়ে রোহিঙ্গা দমনের পথ পরিহার করে ভিন্নপথে হাঁটার মধ্য দিয়ে এই সংকটের নিরসন হতে পারে। জাতিসংঘের মতে, রাখাইন রাজ্যের সংকট নিরসনে রোহিঙ্গাদের কথা শুনতে হবে। তাদের ক্ষোভের কারণ জানতে হবে। দমননীতির মধ্য দিয়ে সংকট নিরসনের চেষ্টা করলে পরিস্থিতির উত্তোরণ সম্ভব নয়। এতে উল্টো জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। শনিবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেনের এক বিবৃতিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ বছর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় গিয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে জঙ্গিবাদবিরোধী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। রোহিঙ্গাদের ইসলামি চরমপন্থা দমনে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন সেনা কর্মকর্তারা। এই কথিত অভিযান চলার সময়ই ১২ নভেম্বর হত্যাকা-ের শিকার হন এক সেনাকর্মকর্তা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেন তার বিবৃতিতে অক্টোবরের ৯ তারিখের সীমান্ত পোস্টে হামলা এবং পরবর্তী সময়ে গত ১২ নভেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানান। পাশাপাশি সংকটের উৎস খুঁজে বের না করায় সেনাবাহিনীর দমননীতির সমালোচনা করেন। রাদ বলেন, ‘এগুলো কঠিন অপরাধ; এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও পরিকল্পনাকারীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে যতটুকু জেনেছি, ওইসব অপরাধের জন্য নিরাপত্তাবাহিনী পুরো সম্প্রদায়কে শাস্তি দিচ্ছে। তাদের প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।’
মিয়ানমার যাকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান বলছে, জাতিসংঘের হিসাব মতে, সেই সেনা-দমন প্রক্রিয়ায় এরইমধ্যে ৮৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ঘরহারা হয়েছেন ৩০ হাজার মানুষ। এর মধ্যে ২৭ হাজার আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। মিয়ানমারের কথিত ওই সেনা অভিযানকে এরইমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযোগ এনেছে সংস্থাটি। স্যাটেলাইট ইমেজে মিয়ানমারের বিপন্ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ির দৃশ্য বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংবাদমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞার পরও বিভিন্ন মিডিয়ার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেখানকার হত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়নের ভয়াবহ বাস্তবতা।
শুক্রবারের বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেন অভিযানের নামে এই ভয়ঙ্কর দমননীতিকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে চিহ্নিত করেন। নিরাপত্তা বাহিনীর এমন মনোভাবকে ‘ভুল’ বলেও অ্যাখ্যা দেন তিনি। বিরোধপূর্ণ উত্তর রাখাইনে শান্তি ফেরাতে দেশটির সরকারকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ নিরসনের তাগিদ দেন তিনি। রাদ বলেন, ‘আমি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে পেছনে ফিরে দীর্ঘদিন ধরে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে ওই অঞ্চলে চালানো নিরাপত্তা অভিযানের প্রভাব বিবেচনা করতে অনুরোধ করছি। মিয়ানমার উত্তর রাখাইনের পরিস্থিতি যেভাবে সামলাচ্ছে, তা খারাপ পরিস্থিতিকে কী করে নিকৃষ্ট অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়, তারই একটি উদাহরণ হতে পারে।’
রাখাইন রাজ্যে চলমান জাতিগত নির্মূলপ্রক্রিয়া নিয়ে ক’দিন আগেই মিয়ানমারকে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করেছে। তাদের আশঙ্কা, রোহিঙ্গা-নিপীড়নের কারণে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে। সেই ধারাবাহিকতায় মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রধানও বলেছেন, রোহিঙ্গা-নিপীড়নের কারণে আইএস-এর উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়নের কারণে চরমপন্থার উত্থান-সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরাও।
শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানও একই আশঙ্কা জানান। বলেন, ‘দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, দুনিয়ায় এখন এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যে, সমস্যার মূল না খুঁজে সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার চলছে নিরাপত্তার অজুহাতে। এর ফল হয়েছে ভয়ানক। অনেকেই ঘর হারিয়েছেন। তাতে বিকশিত হয়েছে সশস্ত্র জঙ্গিবাদ।শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই পরাজিত হয়েছি।‘
জাতিসংঘ মনে করছে, যেভাবে মিয়ানমারের সরকার গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগকে বানোয়াাট বলে উড়িয়ে দিচ্ছে এবং সেখানে স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না, তা ঘটনার শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই অবমাননাকর। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার রা’দ মনে করছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযাযায়ী মিয়ানমারের সরকারের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, এর মাধ্যমে সেগুলো এড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।
মিয়ানমারের সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন রাজ্যে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। সেখানে প্রবেশাধিকার নেই সংবাদমাধ্যমেরও। জেইদ রা’দ আল হুসেন এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন তোলেন, ‘ মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের যদি লুকোনোর কিছু না থাকে, তাহলে কেন তারা সেখানে আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না? যেভাবে তারা আমাদের সেখানে ঢুকতে অনুমতি দিতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে, তাতে করে আমরা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সবচেয়ে খারাপটাই আশঙ্কা করছি।’
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত এবং অবহেলিত জনগোষ্ঠী বলে স্বীকৃত। রাদ মনে করেন, জঙ্গিবাদ রুখতে ও সংকট উত্তোরণে তাদের ‘ক্ষোভের কথা শুনতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে তা মেটাতে কাজ করতে হবে।‘ তিনি বলেন, ‘ যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মিলবে, সেখানে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করে দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নোবেলজয়ী অং সান সু চিকে বিরোধপূর্ণ উত্তরাঞ্চল পরিদর্শনের আহ্বান জানানোর সপ্তাহখানেক পর এই বিবৃতি এলো জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তরফ থেকে। তবে অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারও জাতিসংঘের অভিযোগের বিপরীতে মিয়ানমারের কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।