শামস শামীম::
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের গৌরবের ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপনের দ্বিতীয় দিন ছিল আরো উৎসবময়। রচচঙ পোষাকে সেজে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ছুটে আসেন নারকেল বিথী তপোবনের স্মৃতির ক্যাম্পাসে। চুটিয়ে আড্ডা ও স্মৃতিচারণে ফিরে গিয়েছিলেন অতীতের সোনালু দিনের কাছে। মঞ্চও মাঠ জুড়ে ছিল সেই আবহ। বিশেষ করে রাতে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার সময় মাঠছিল লোকময় উৎসবমুখর। নেচে গেয়ে আনন্দ উদযাপন করেন তারা। এই সময় ব্যাচ ভুলেও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ডুকে পড়েন একে অন্যের নাচের শিবিরে। তুমুল আহ্লাদে মাতেন তারা।
তবে রাত ১০টায় কার্যকরি আহ্বায়ক নূরুল হুদা মুকুট ও আহ্বায়ক এডভোকেট হুমায়ূন মঞ্জুর চৌধুরী যখন উৎসবের সমাপনী ঘোষণা করেন তখন উৎসবমুখর মাঠে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। এই নীরবতার মধ্যেই এক মিশ্র আনন্দ অনুভূতি ও সুখময় আবহ নিয়ে ঘরে ফিরেন হাজারো প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বন্ধুদের সঙ্গে বিদায়ী আলিঙ্গন করে আবারও দেখা হবার বাসনায় বিদায় নেন।
দুপুর আড়াইটায় যখন ব্যাচ ভিত্তিক পরিবেশনা শুরু হয় তখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা ছিল প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কার আগে কোন ব্যাচ পরিবেশনায় যাবে সেটা নিয়ে উপস্থাপকবৃন্দ বিপাকে পড়েন। সবাই নিজেদের ব্যাচের পরিবেশনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এভাবেই বিভিন্ন ব্যাচ দুপুর থেকে সন্ধ্যা নামার আগে নিজেদের বহুমুখি উপস্থাপনায় ফেলে আসা ঝলমলে দিনের স্মৃতি রোমন্থন করেন। স্¥ৃতির জাবরকাটা অনুষ্টানও মাঠে উপস্থিত প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের চিত্তে দোলা দেয়।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ের বাঘা নেত্রী রাণী রায়ের নেতৃত্বে ছুটে আসেন ৬৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। ডাগর চোখের রাণী রায় মাইক্রোফোন নিয়েই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্মৃতিচারণ করেন। ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র লীগসহ সকল ছাত্রনেত্রীবৃন্দের কথা স্মরণ করেন। কিভাবে ছাত্রনেতারা তাকে সমীহ করতেন সেসব স্মৃতিচারণের পাশাপাশি স্বামীর পদবী ‘সেন’ ছেটে কিভাবে এখনো তিনি সুনামগঞ্জের ছাত্রনেতা রাণী রায় হয়ে আছেন সেই গল্প করেন। তাকে সঙ্গ দেন তার অন্যান্য বান্ধবীরা। তার বন্ধু সুখেন্দু সেন হারু মাইক্রোফোন নিয়ে স্মৃতিচারণে পুরনো দিন সামনে নিয়ে আসেন।
৬৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবাই ছিলেন নারী। তাদের অনেকেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। হাসিহাসি মুখে তারা মঞ্চে এসে রাধারমণের ধামাইলগান পরিবেশন করেন। তারা পুরুষ বন্ধুদের ডেকেও পাননি। তবে তাদের পরিবেশনার শেষবেলায় তাদের বন্ধু বিকাশ রঞ্জন চৌধুরী ভানু ও কটি দাস ছুটে আসেন। এভাবেই শেষ হয় এই ব্যাচের স্মৃতিময় পরিবেশনা।
মঞ্চ আলো করে অবস্থান নেন ৭২ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। প্রফেসর কল্পনা তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ূন বখত মুহিত এবং ডা. সালেহ আহমদ আলমগীরের নেতৃত্বে তারা স্মৃতিচারণ করেন। পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাওয়া বন্ধুদের স্মরণ করেন তারা। এভাবে প্রতিটি ব্যাচই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে। তারা হাসি-আনন্দে-গান-নাচ-কবিতা আবৃত্তিসহ বহুমুখি পরিবেশনায় মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের। তারা এই কলেজকে নিজেদের তীর্থভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে বারবার ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উৎসবময় হয়ে ওঠে। প্রথম দিনের চেয়ে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যারাত আরো ঝলমলে ছিল। মাঠভর্তি ছিলেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ দর্শকরা। সপরিবারে ছুটে এসেছিলেন তাদের অনেকেই। পেন্ডালের নিচে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তারা দাড়িয়েই অনুষ্টান উপভোগ করেন। এসময় মাঠের প্রতিটি কোণেই বিভিন্ন গ্রুপ নাচতে থাকেন। সাতটা থেকে একটানা দশটা পর্যন্ত ছিল জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আখি আলমগীর ও সোহেল মেহেদী শ্রোতাদের তম্ময় করে রাখেন।
রাত ১০টার পর ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের কার্যকরি আহ্বায়ক নূরুল হুদা মুকুট, আহ্বায়ক এডভোকেট হুমায়ূন মঞ্জুর চৌধুরী, সদস্যসচিব রুহুল তুহিনসহ আয়োজকরা মঞ্চে আসেন। এসময় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করতে গিয়ে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। নূরুল হুদা মুকুট বলেন, দুদিন ব্যাপী প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের এই উৎসব মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। উৎসবে প্রাণ খুলে শরিক হয়েছেন সবাই। নানা সীমাবদ্ধতার পরও অনুষ্টান সফল হয়েছে। অনুষ্ঠান সফল করায় প্রাক্তন শিক্ষার্থী সকলকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
আহ্বায়ক এডভোকেট হুমায়ূন মঞ্জুর চৌধুরী তার স্বভাবসুলব বিনয়ী ভঙ্গিতে বলেন, আমাদের উৎসব আয়োজনে সকল ব্যর্থতা আমার। এর সফলতা অংশগ্রহণকারী প্রাক্তন শিক্ষার্থী সকলের। নানা ঘাত প্রতিঘাত ও দোলাচলের পরও আমরা অনুষ্ঠানটি করতে পেরেছি এটাই শান্তনা। সবাই প্রাণ খুলে উৎসবে অংশ নিয়েছেন। তাদের বক্তব্যের পরেই মাঠ ছাড়তে থাকেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
এর মধ্যেই র্যাফেল ড্র নিয়ে মঞ্চে আসেন এডভোকেট বিমান কান্তি তালুকদার, নাদির আহমদ, বোরহান উদ্দিন দোলনসহ প্রাক্তন ছাত্রনেতারা। তারা উপস্থিতিতের সামনেই র্যাফেল ড্রর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন। বিজয়ীদের হাতে দুটি এলইডি টিভি, দুটি মোবাইল ফোন ও ৬টি অন্যান্যা পুরস্কার প্রদান করেন।
এভাবেই দুই দিনের উৎসবের সমাপ্তি হয়। জীবনের স্মৃতিময় ক্যাম্পাসে ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে তারা আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খোঁজ পেয়ে অন্যরকম ভালোলাগা নিয়ে তারা ঘরে ফিরেন।