স্টাফ রিপোর্টার::
দীর্ঘদিন ধরে জেলার আপামর সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, কর্মীদের মূল্যায়ন, দলের প্রতি আতœত্যাগ, সময় মতো সংঘবদ্ধ ও সমন্বিত প্রচারণা এবং পারিবারিক পরিকল্পিত প্রচারণাসহ নানা কারণে নূরুল হুদা মুকুট বিজয়ী হয়েছেন বলে মনে করেন তার সমর্থক, কর্মী ও নির্বাচনী বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পর্কের অভাব, আন্তরিক কর্মীদের অভাব, রাজনীতিতে স্ট্রাগল না করাসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এম. এনামুল কবির ইমন পরাজিত হয়েছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাছাড়া স্থানীয় সাংসদরা তার বদলে সাধারণ সদস্য পদে নিজেদের আতœীয়-স্বজন ও ঘনিষ্টজনদের নিয়ে ব্যস্থ থাকার কারণে প্রকৃতপক্ষে তার পক্ষে কাজ করেননি। আ.লীগের সাংসদরা আন্তরিক ছিলেন সদস্য পদের নিজেদের প্রার্থীদের নিয়ে।
জানা গেছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু থেকেই চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হচ্ছেন এই প্রচারণায় এগিয়ে ছিলেন নূরুল হুদা মুকুট। তার বিশাল কর্মী-সমর্থক এই খবর পৌছে দেন তৃণমূলে। গত ৫ নভেম্বর সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র আয়ূব বখত জগলুলের উদ্যোগে জেলার স্থানীয় সরকারের সকল প্রতিনিধিদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এই সংবর্ধনাসভায় উপস্থিত তৃণমূলের সকল প্রতিনিধিরা জেলা পরিষদ নির্বাচনে নূরুল হুদা মুকুটকে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করেন। আয়ূব বখত জগলুল নূরুল হুদা মুকুটকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আন্তরিক প্রচারণা চালান। দলের সিনিয়র ও দায়িত্বশীল অনেক নেতা ছিলেন তার পক্ষে। তাছাড়া আওয়ামী দলীয় সমর্থনের জন্য বায়োডাটা আহ্বান করলে বায়োডাটা জমা দেন তিনি। কিন্তু সমর্থন না পাওয়ায় হতাশ হন তার সমর্থকরা। শেষমেশ তিনি দলের সমর্থন ছাড়াই তৃণমূল প্রতিনিধিদের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে নামেন। শুরু থেকেই তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবেও প্রচারণায় বিষয়টি গুরুত্ব পায়। তার অগুনতি কর্মী-সমর্থকরাও রাতদিন প্রচারণা চালান। জেলা আওয়ামী যুবলীগ প্রকাশ্য তার পক্ষে মাঠে নামে। জেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বিরামহীন প্রচারণা চালান নূরুল হুদা মুকুটের পক্ষে।
সুনামগঞ্জের প্রখ্যাত ব্যবসায়ীরাও নূরুল হুদা মুকুটের পক্ষে মাঠে নামেন। তারাও প্রচারণায় নামায় নতুন মাত্রা পায় নির্বাচন। নূরুল হুদা মুকুটের পরিবার নির্বাচন শুরুর আগেই পারিবারিক বৈঠক করে তাকে সমর্থন ও সর্বাতœক সহায়তা করে। তারা টিমওয়ার্ক করে আতœীয়তার বন্ধন খুজে রাতদিন কাজ করেন। তার স্ত্রী প্রতিদিন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্যদের নম্বর ও তালিকা সংগ্রহ করে প্রতিদিন ফোনে কথা বলেন। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত সকল নারী সদস্যদের সঙ্গেই তার একাধিকবার কথা হয়েছে। তিনি বিনয় ও আন্তরিকতার সঙ্গে স্বামীকে সমর্থন দানের আহ্বান জানান। তার বিনয়ী আহ্বানে সাড়া দেন নারী প্রতিনিধিরা। তাকে অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্বামীকে ভোটদানের।
নির্বাচনী বিশ্লেষকরা মনে করছেন নূরুল হুদা মুকুটের এমন পরিকল্পিত প্রচারণাই তার বিজয়ের কারণ।
নূরুল হুদা মুকুটের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সজীব রঞ্জন দাশ বলেন, আমরা একটি কমপ্লিট নির্বাচন করেছি। সবাই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে আমরা প্রচারণায় এগিয়ে থাকায় আশানূরূপ সাড়া পেয়েছি। তাছাড়া রাজনীতির মাঠে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণেও তারা নূরুল হুদা মুকুটকে দেওয়া কথা রেখেছেন। রাজনীতির ত্যাগী ও উপেক্ষিত মানুষটিকেই বেছে নিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
এদিকে ব্যারিস্টার ইমনের পরাজয়ের নানা কারণ খুজে পেয়েছেন বিশ্লেষকরা। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জেলা পরিষদের ভোটার হলেও সাধারণ জনতাও এতে অনুঘটক বা প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে কাজ করছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অভিজ্ঞজনরা জানান। তাদের মতে ব্যারিস্টার ইমন কোন স্ট্রাগল না করে স হজেই দল থেকে অনেক কিছু পেয়ে গেছেন। এর বিপরিতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও ছিল তার দূরত্ব। তার প্রচারণায় প্রভাব বিস্তারকারী স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বা ফেইসভ্যালু আছে এমন জনপ্রতিনিধিদের দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকরা আরো মনে করেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীতা নিয়ে ব্যারিস্টার এম. এনামুল কবির ইমন প্রথমে দোদুল্যমান ছিলেন। নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু হলেও তিনি ছিলেন নিরব। শেষ দিকে আওয়ামী লীগ থেকে আগ্রহী প্রার্থীদের বায়োডাটা প্রদানের আহ্বান জানানো হলে তিনি বায়োডাটা জমা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তদবির করে সমর্থন আদায় করেন। মনোনয়ন জমাদানের একদিন আগে জানতে পারেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও তার সমর্থকরা। মনোনয়ন জমাদানের পর ব্যস্ততায় চলে যায় আরো এক সপ্তাহ। ফলে তিনি ১২১৫ জন ভোটারের কাছে পৌঁছতে পারেননি।
গতকাল নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সকলের কাছে যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। তাছাড়া নির্বাচন পরিচালনার জন্য তার নিজস্ব লোক ও আতœীয় স্বজনদের উপস্থিতিও কম ছিল। যারা তার আশপাশে ছিল তাদের বেশিরভাগই ছিল সুবিধাভোগী প্রকৃতির ও বিভিন্ন গ্রুপ থেকে আসা। কাজের বদলে ফেইসবুকে দুএকটি প্রচারণার ছবি আপলোড করেই দায়সারা কাজ করেছে তারা।
তাছাড়া সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউনিয়ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়েও অনেক চেয়ারম্যান-মেম্বার ও তাদের সমর্থকরা ব্যারিস্টার এম. এনামুল কবির ইমনের প্রতি ক্ষুব্দ ছিলেন। দলীয় সমর্থন না পাওয়ায় তারা ইমনের প্রতি এই নির্বাচনে জবাব দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন।
অনেকে জানিয়েছেন দুইবার জেলা পরিষদের প্রশাসক হলেও স্থানীয় জনগণ, তৃণমূল কর্মী-সমর্থক থেকে দূরে ছিলেন তিনি। একটি তোষামোদী গোষ্ঠী তাকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিল। তারা মাঠের প্রকৃত তথ্য তার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছিল। তাছাড়া বেশির ভাগ সময়েই তিনি ঢাকায় অবস্থান করার কারণেও সবার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। তিনি যোগাযোগের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারাও সেই কাজ করেনি।
ব্যারিস্টার ইমনের ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে নির্বাচনে স্থানীয় সাংসদদের ঘনিষ্টজনরা তার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী বৈতড়ণি পার হয়েছেন। কিন্তু তার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেনননি।