সৈকতুল ইসলাম শওকত::
নেতাদের নেতা হোসেন বখত-এর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।
পৃথিবীতে যুগে যুগে কিছু ক্ষণজন্মা ব্যক্তির জন্ম হয় আজীবন যারা মানুষকে দিয়ে যান, নিয়ে যান না কিছুই। হোসেন বখ্ত ছিলেন তাঁদেরই একজন। ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকায় থাকার পরও নিজেকে জাহির করতে চাননি। সবসময় থেকেছেন পর্দার আড়ালে। বঙ্গবন্ধুর একান্ত আস্থাভাজন হোসেন বখ্ত স্বাধীনতার পর চাইলেই এমপি হতে পারতেন, কিন্তু ক্ষমতার আকাক্সক্ষা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার পরও পদ-পদবীতে নিজে আসীন হননি। অন্যের জন্য পথ তৈরি করে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার এই বিরল দৃষ্টান্ত হোসেন বখ্তই রেখে গেছেন। জীবদ্দশায় যে উচ্চতায় থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন, চাইলেই নিজের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন কিন্তু পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
স্থানীয়ভাবে সুনামগঞ্জে যাঁরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম জননেতা হোসেন বখ্ত। শহরের আরপিননগরস্থ তালুকদার বাড়িতে ১৯২৫ সালের ৬ জুন তাঁর জন্ম। সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে চলে যান সিলেটে। ভর্তি হয়েছিলেন পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে। সে সময় ভারত বিভক্ত হয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান নামক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সিলেট কী ভারতে থাকবে নাকি পাকিস্তানে আসবে- এ নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় গণভোট। হোসেন বখ্ত সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে যোগ দেন গণভোটের প্রচারণায়। এরপর আর ফিরে যাননি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পদিনের মধ্যেই শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন তিনিও। আন্দোলনের নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকায় গ্রেফতার হন। বছর তিনেক পর মুক্তি পেলেও অল্প দিনের ব্যবধানে আবারও যেতে হয় কারাগারে। রাজনীতির কারণে তাঁকে আরো তিনবার কারাগারে যেতে হয়।
সিলেটে গণভোটের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতখড়ি তাঁর। ভাষা আন্দোলনে ও যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। তখন থেকে প্রতিটি গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে পরিণত হন সুনামগঞ্জ জেলার একজন প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে। তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক কর্মকা- ও প্রজ্ঞা বঙ্গবন্ধুর গোচরে আসে। দ্রুত বাঙালির মহানায়ক শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন হোসেন বখ্ত।
১৯৬৯ সালে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানেও সুনামগঞ্জের অন্যতম প্রধান নেতা হোসেন বখ্ত। বঙ্গবন্ধু কারামুক্তির পর সুনামগঞ্জে প্রথম জনসভা করেন। সেই সময় হোসেন বখ্ত বঙ্গবন্ধুর সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। সেই সময় এখানে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত ছিল না। সেই জন্য সিলেট হতে দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী কমিটি গঠনের জন্য সুনামগঞ্জে আসেন। আফাজ উদ্দিন সাহেবের দোকানে সভা আহ্বান করা হয়। সভায় অংশগ্রহণকারীরা হোসেন বখ্তকে সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি করার মতপ্রকাশ করেন। কিন্তু দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন হোসেন বখ্ত।
এমনই এক ত্যাগী মানুষ ছিলেন বখ্ত সাহেব পদ-পদবীর আর ক্ষমতার মোহ তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। রাজনৈতিকভাবে জীবদ্দশায় যে উচ্চতায় ছিলেন, চাইলেই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এমপি হতে পারতেন। সেসবের প্রতি তাঁর ছিল অনীহা। জনগণের ভালবাসার মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকতেন। যে কারণে তিনি কেবলমাত্র জননেতা ছিলেন না, ছিলেন নেতাদেরও নেতা। রাজনীতিতে সহযোদ্ধাদের ত্যাগের ছবক শিখিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি ইয়াহিয়া জান্তা সরকার। শুরু হল অসহযোগ আন্দোলন। সুনামগঞ্জে সেই আন্দোলনে অগ্রযোদ্ধা হোসেন বখ্ত। সেই সময় তাঁকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল ন্যাপ, ন্যাপ (ভাসানী) এবং কমিউনিস্ট পার্টি। সবার কাছেই তিনি ছিলেন গ্রহণযোগ্য। হোসেন বখ্ত সাহেব-এর বুদ্ধিমত্তা ছিল খুবই তীক্ষè ও ক্ষুরধার। অনেক জটিল সমস্যা অত্যন্ত সহজভাবে সমাধানে তাঁর জুড়ি ছিল না। সকল দ্বন্দ্ব-কলহের সমাধান দিতেন মুহূর্তের মধ্যে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন হোসেন বখ্ত। সংগঠকের ভূমিকায় থেকেও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। সে সময় তাঁর ছেলে মনোয়ার বখ্ত নেকও (প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান) ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। পুরো তালুকদার বাড়ির মানুষজন মুক্তিযুদ্ধে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। এর খেসারত দিতে হয়েছে তাদেরকে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী গুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাস্তুহারায় পরিণত হন তারা। সেই অবস্থায় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন। কোনরকম সরকারি সহায়তা ছাড়াই। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় থাকার পরও সরকারি সুযোগ-সুবিধা হাতের কাছে পেয়ে তা নিজের কাজে না লাগিয়ে সততার অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছেন হোসেন বখ্ত। সুনামগঞ্জ মহুকুমা প্রশাসক পুনর্বাসনের জন্য তাঁকে সহায়তার প্রস্তাব দিলে, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বলেছেন, তার থেকে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষও রয়েছেন। তাদের যেন সাহায্য করা হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ঢাকার মিরপুরে বাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। সেই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন একই কথা বলে। এমন নির্লোভ চরিত্রের কারণে হোসেন বখ্ত মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসনে বসে আছেন। এই জন্য তিনি নেতাদের নেতা।
ক্ষণজন্মা এই পুরুষ ১৯৭৩ সালের ২ মার্চ সিলেট মেডিকেল কলেজে রাত ১০.১৫ মিনিটে ইহলোক ত্যাগ করেন। রেখে গেছেন আত্মত্যাগের এক মহিমাময় ইতিহাস। ঘুনে ধরা আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতির এই জামানায় হোসেন বখ্তের জীবন থেকে আত্মত্যাগের চবক নেয়া খুবই জরুরি।