শামস শামীম::
আফ্রিকা অঞ্চলের ভাইরাস এলএসডি ((লাম্পিং স্কিন ডিজিজ) প্রথম বারের মতো দেখা দিয়েছে হাওরে। আর এতে আক্রান্ত হচ্ছে হাওরাঞ্চলে হালচাষের অন্যতম প্রধান মাধ্যম গরু। গত দুই সপ্তাহে দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় মারা গেছে অন্তত অর্ধশতাধিক গরু। করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনের সময়ে পশুদের মধ্যে এই নয়া ভাইরাস রোগ নিয়ে চিন্তিত হাওরপাড়ের কৃষক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন অতীতে বাংলাদেশে এই রোগ ছিলনা। তবে পার্শবর্তী ভারতে কয়েক বছর আগে পশুদের এই রোগ দেখা দিয়েছিল। ভারত থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যেসব গরু আসে তা থেকেই এই নয়া ভাইরাস বাংলাদেশেও ছড়িয়েছে। গরু ছাড়া অন্য গবাদিপশুতে এখনো এই রোগ ছড়ানোর কোন আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
জানা গেছে, প্রথম বারের মতো বাংলাদেশে এই ভাইরাস গত অক্টোবর মাসে দেখা দেয়। জেলায় এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৫৫টি গরু এই নয়া ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এলএসডি রোগে মৃত্যুর বিষয়টি জানেনা জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ! প্রাণি সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে এই রোগ পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ানোরও কোন আশঙ্কা নেই।
জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ সূত্র আরো জানায়, গত অক্টোবর মাসে সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে গরুর মধ্যে ভাইরাসজনিত রোগ এলএসডির সন্ধান পাওয়া যায়। ভারত থেকে আসা গরু থেকেই এই রোগ প্রথম বারের মতো হাওর এলাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়েছে। আফ্রিকা, ইথোপিয়া, সুদানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই রোগ কয়েক বছর আগে ভারতে গরুর মধ্যে ছড়ায়। বাংলাদেশে এর আগে এই রোগ ছিলনা। ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সেসব গরু বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশে ডুকছে তা থেকেই এই রোগ বাংলাদেশের পশুতে ছড়িয়েছে।
এদিকে আক্রান্ত এলাকা দিরাই শাল্লার কৃষকরা জানিয়েছেন গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তাদের গরু গুলো মারা গেলেও জেলা প্রাণীসম্পদ বিভাগ এ বিষয়ে কোন খোঁজ নেয়নি। তারা গ্রাম্য গবাদিপশু চিকিৎসকের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা নিয়েও আক্রান্ত গবাদিপশু বাঁচাতে পারছেন না। প্রাণি সম্পদ বিভাগের কোন তৎপরতাও নেই বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, গরুর দুই পায়ের মধ্যখানে সিনায় ফোস্কা দেখা দেয়। পরে সেখানে পানি জমতে থাকে। আস্তে আস্তে গরুগুলো মারা যায়। জিহ্বায়ও ফোস্কা দেখা দেয়। তাই অবিরত লালা ঝরে। তাছাড়া শরিরের বিভিন্ন স্থানেও ফোস্কায় পানি জমে একসময় নিস্তেজ হয়ে মারা যায় পশুগুলো। তারা স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকদের কাছ থেকে ওষুধপত্র নিয়েও বাঁচাতে পারেননি নিজেদের হালের গরু। আক্রমণও প্রতিহত করতে পারছেন না। তাই নয়া এই রোগ নিয়ে কৃষকরা চরম উদ্বিগ্ন।
কৃষকরা জানান, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার উজানগাঁও গ্রামের গফুর মিয়া, বাবুল মিয়া, চান মিয়া ও সিরাজ মিয়াসহ একাধিক কৃষকের গরু মারা গেছে। তাছাড়া পার্শবর্তী শর্মা গ্রামের আব্দুর রশিদ, পেরুয়া গ্রামের অমরচান, ব্রজেন্দ্রদাহ, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা কুলসুম বিবি, হরিধন দাস, এরশাদ মিয়া ও আব্দুর রহমানের কয়েকটি গরুও কয়েকদিনের ব্যবধানে মারা গেছে। এভাবে আশপাশের অন্তত ৫০টি গরু মারা গেছে নয়া এই রোগে।
পেরুয়া গ্রামের কৃষক নেতা অমরচান দাস বলেন, আমাদের হাওরে এর আগে ক্ষুরারোগে বিভিন্ন সময়ে গরু মারা যেতো। কিন্তু এ বছর যে রোগ দেখা দিয়েছে সেই রোগ অতীতে আমরা কখনো দেখিনি। তিনি বলেন, আমার একটি গরু মারা গেছে গত শুক্রবার। গরুর সিনাতে কয়েকদিন আগে বড় ফোস্কা দেখা দিয়েছিল। পরে এই ফোস্কায় পানি জমে। শুধু আমার নয় আমার এলাকার বিভিন্ন গ্রামে অন্তত ৫০জন কৃষকের গরু মারা গেছে। করোণা ভাইরাসের সময়ে গরুতে ভাইরাসজনিত এই রোগ দেখা দেওয়ায় কৃষকরা আরো আতঙ্কিত।
বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা কুলসুম বিবি বলেন, আমি গরিব মানুষ। গত কয়েকদিন আগে নয়া রোগে আমার ৩টা গরু মারা গেছে। বাজার থেকে ওষুধ এনে গরুগুলোকে খাইয়েও বাঁচাতে পারিনি। তিনি বলেন, গরুর শরিরে বড় বড় ফোস্কা। পরে জিহ্বা দিয়ে অনবরত লালা পড়েছে। আমরা অতীতে গরুর এমন রোগ দেখিনি। আমাদের এলাকার বিভিন্ন গ্রামে এমন রোগে কৃষকরা চিন্তিত থাকলেও পশু অফিসের লোকজনের কোন খবর নাই।
শ্যামারচর বাজারের গবাদিপশু চিকিৎসক মো. ময়না মিয়া বলেন, গত ২-৩ মাসে আমি ৫০০ গরুর চিকিৎসা করেছি। এই রোগ আগে দেখিনি। প্রতিদিনই সিনায়, পায়ের রানে, ফোস্কা ও পানি নিয়ে আক্রান্ত একাধিক গরু নিয়ে আসছেন কৃষক। আমি চিকিৎসা দিচ্ছি। অনেক গরুই ভালো হয়ে যাচ্ছে। তবে কয়েকটি গরু মারাও গেছে।
চরনারচর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য রূপক রায় চৌধুরী বলেন, গত তিনচারদিন আগে আমি পুরান সুরমায় ৬-৭টি মরা গরু ভেসে যেতে দেখেছি। নতুন এই রোগে কৃষকদের গরু মারা যাচ্ছে। অনেক গরু মারা যাচ্ছে আমাদের এলাকায়।
জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, গত অক্টোবর প্রথম বারের মতো আমাদের সুনামগঞ্জে এলএসডি ভাইরাস রোগ দেখা দিয়েছে। মূলত ভারত থেকে যেসব গরু দেশে আসছে তা থেকেই ছড়িয়েছে এই রোগ। আমাদের দেশে এই রোগ অতীতে ছিলনা। এ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। হাওরাঞ্চলে এই রোগে গরু মারা গেছে কি না তা আমাদের রেকর্ডে নেই। তাছাড়া এমএসডি (ক্ষুরারোগ) রোগেও গরু মারা যেতে পারে। তবে এই রোগ মানব শরিরে আক্রমণের কোন সুযোগ নেই বলে জানান তিনি। নয়া এই রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতর চিন্তিত বলে জানান তিনি।