দু:সহ করোনা সংকট সামাল দিচ্ছে বিশ্ব। এক অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে চুরমার হয়ে পড়ছে সম্পর্ক, কর্তৃত্ব কী বেঁচে থাকার ময়দান। কে জানে করোনার পর পৃথিবী কেমন হবে? কেমন হবে শ্রেণি ও বর্গেও সম্পর্ক আর কর্তৃত্বেও ধরণগুলি। বাংলাদেশ নানাভাবে সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশের তিরিশ লাখ আদিবাসী জনগণের জায়গা কী মিলছে করোনা মোকাবেলার মূলধারার তৎপরতায়? জাতিগতভাবে প্রান্তিক আদিবাসীরা যে দেশের এক গরিব মেহনতি প্রান্তজন। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা কী চিকিৎসা-তৎপরতাগুলো আদিবাসীগ্রাম অবধি পৌঁছায় কম। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব না দিয়ে অধিপতি স্বাস্থ্য-তৎপরতা অনেক সময় আদিবাসী জনগণের স্বাস্থ্যসংকটকে বুঝতেও ব্যর্থ হয়। তো এই প্রান্তিকতার রেখায় দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী জনের জন্য করোনাসংকট মোকাবেলায় আমাদের বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। অরণ্য-পাহাড়-উপকূল-গড় কি সমতলের সকল আদিবাসীজন কে করোনা-তৎপরতায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা জরুরি।
২.
বাংলাদেশে আদিবাসীজনগণের সাংবিধানিক পরিচয়ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, উপজাতি এবং নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। দেশের অধিকাংশ আদিবাসী ঘন অঞ্চল পর্যটনস্থল। কক্সবাজার-কুয়াকাটায় রাখাইন ও তঞ্চংগ্যারা আছেন। লাউয়াছড়া-সাতছড়ি-মাধবকুন্ড-জাফলং-রাতারগুলে খাসি, মণিপুরী, লালেং রা বসবাস করেন। বৃহত্তর সিলেটের চা বাগানগুলি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল এবং এখানে বাস করেন পঞ্চাশেরও বেশি আদিবাসী জাতি। মধুপুর-বিরিশিরি-গজনী-মধুটিলা-ভাওয়ালমান্দি, হাজং ও কোচ অঞ্চল। পার্বত্য চট্ট্রগ্রামে ১১ জাতি সত্তার বাস। সুন্দরবনে মুন্ডা, বাগদী ও মাহাতোদের বাস। বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলে সাঁওতাল, কোল, কড়া, কডা, ওঁরাও, মাহাতোরা থাকেন। বিশ্বে করোনার সংক্রমণ যখন ছড়িয়ে পড়ছে তখনো কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল-সিলেট-চাবাগান কী উত্তরাঞ্চলে বহিরাগতদের পর্যটন থামেনি। সংক্রমণ এড়াতে রাষ্ট্র যখন পরিবহন বন্ধ, লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনের সিদ্ধান্ত নেয় তখন আদিবাসী অঞ্চলে বহিরাগতদের ভ্রমণ বন্ধ হয়। যখন বিশ্ব কাঁপছে করোনায় তখনি রাঙামাটির সাজেক ও বান্দরবানের লামায় হামে আক্রান্ত হচ্ছে ত্রিপুরা ও ¤্রাে শিশুরা। খাদ্যহীনতা, অপুষ্টি আর উচ্ছেদের শংকা আদিবাসীজীবনের নিত্যসঙ্গী। জ্বর, সর্দি, কাশিসহ করোনার সাথে মিলে যাওয়া উপসর্গ গুলো নিয়েই বাঁচে গরিষ্টভাগ আদিবাসীসমাজ। আদিবাসী অঞ্চলে যেমন বহিরাগত মানুষেরা ঘুরতে আসে তেমনি আদিবাসীদেরও জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয়। দিনমজুরি, কৃষিশ্রমিক, গার্মেন্টস কী শহওে এসেও নানা কাজে জীবন টিকিয়ে রাখতে হয়। করোনার মতো সংক্রমণ এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়, একজন থেকে বহুজনে। করোনার কালে আদিবাসী ঘন অঞ্চলে পর্যটনের মাধ্যমে ব্যাপক বহিরাগত জনসমাগম ঘটেছিল। কিন্তু আমরা সেসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করিনি, সেইসব এলাকায় বিশেষ সতর্কতা জারি করিনি, বিশেষ স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করিনি। পাহাড় থেকে সমতল আদিবাসী জীবনে তাই করোনার আতংক ও শংকা নানাভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং এটি ক্রমান্বয়ে যন্ত্রণাময় এক মানসিক চাপও তৈরি করছে।
৩.
করোনা মোকাবেলায় দেশের আদিবাসী সকল অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর ভেতর স্বাস্থ্যগত তৎপরতা জোরালো হওয়ার নানামুখী অভাব আছে। বারবার সাবান জলে হাত ধোয়ার মতো পর্যাপ্ত পানি কি সাবান নেই অধিকাংশ গ্রামে। আদিবাসীরা মোটাদাগে যে ধরণের ঘওে একসাথে থাকেন সেখানে হোমকোয়ারেন্টিনের মতো কোনো ব্যবস্থাও নেই। তাহলে আমরা কীভাবে করোনা রবিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাবো? যদিও এখনো পর্যন্ত আদিবাসীদের ভেতর করোনা সংক্রমণ ও বিস্তারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিন পার্বত্য জেলায় চলতি আলাপটি তৈরি পর্যন্ত (২৮ মার্চ) করোনা আক্রান্ত কেউ সণাক্ত হয়নি। তবে বিদেশ ফেরত ১৫৯ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। রাঙামাটিতে ৬২ জন, খাগড়া ছড়িতে ৮৯ জন এবং বান্দরবানে ৮জন। তবে করোনা সংকট শুরুর পর এই তিন জেলায় প্রায় ৫২২ জন ব্যক্তি বিদেশ থেকে এসেছেন বলে নানা সূত্রে জানা যায়। করোনার উপসর্গ নিয়ে ২৫ মার্চ খাগড়া ছড়ি সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন শ্বাস কষ্টে ভোগা মহালছড়ির মাইসছড়ি-নুনছড়ির এক আদিবাসী যুবক মারা যায়। মৃত্যুর পর তার সংস্পর্শে আসা দু’জন চিকিৎসকসহ পাঁচজনকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কক্সবাজারের চকরিয়াতে করোনা রোগী সণাক্ত হওয়ার পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম ও লামা লকডাউন করা হয়। চকরিয়ার করোনা রোগী ওমরাহ শেষে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন ১৩ মার্চ এবং ২৪ মার্চ তার সংক্রমণ ধরা পড়ে। করোনা স্বাস্থ্যসচেতনতার তথ্য ও উপকরণকে সুলভে এমনকি কোনো কোনো অঞ্চলে স্ব স্ব আদিবাসী মাতৃভাষায় বহুল প্রচার জরুরি। এমনকি আদিবাসী জীবনের লোকায়ত জ্ঞান ও প্রথাকে এই সংকট মোকাবেলায় সম্মিলিত সামাজিক শক্তি হিসেবে মূলধারায় যুক্ত করা যেতে পারে। যা সামগ্রিক মানসিক সংকট কাটিয়ে জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাসের ঐক্য তৈরি করতে পারে।
৪.
দেখা গেছে সুন্দরবনে রমুন্ডা, বাগদী আদিবাসীরা করোনার কালে তাদের গ্রামে বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। এমনকি সন্ধ্যায় প্রবেশপথে ধূপ-বাতি জ্বালিয়ে মহামারী ও বিপদ দূর করবার চেষ্টা করছেন। শ্রীমঙ্গলের ডলু বাড়ি ত্রিপুরী কামির (গ্রাম) প্রবেশপথ একেবারেই বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গ্রামে বহিরাগত কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছেনা। সিলেটের খাসি পুঞ্জিগুলো তাদের পানজুম ও এলাকায় বহিরাগত কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা। পাহাড়ি গ্রামেও আদিবাসীরা নিজেদের গ্রাম বন্ধ করেছেন নানা প্রথাগত রীতির মাধ্যমে। করোনা ছড়িয়ে পড়ার প্রাক্কালে দিনাজপুরের সাঁওতাল সমাজ তাদের বাহা উৎসবে জাহের থাননামের পবিত্র স্থলে করোনা থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন। করোনাসংক্রমণ ও বিস্তার রোধে এখনো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরে থাকা ও সঙ্গনিরোধই প্রধান বিধি হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বময়। আর আদিবাসী সমাজে মহামারী ও রোগের সংক্রমণ এড়াতে প্রথাগত ভাবেই এই বিচ্ছিন্নতা ও সঙ্গ নিরোধের চল আছে। কলেরা, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, বসন্ত, হাম, কুষ্ঠ মহামারী মোকাবেলায় রয়েছে নানা পূজাকৃত্য ও সঙ্গনিরোধের লোকায়ত ধরণ। মহামারী থেকে কিছুদিনের জন্য গ্রামকে বিচ্ছিন্ন কওে রাখাকে চাকমা ভাষায় বলে ‘আদামবনগারানা’। গ্রামে প্রবেশের যতগুলো পথ আছে পথের মোড়ে মোড়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে মান্দি আদিবাসীরা দেন মারাং আ আমুয়ার (পূজা) মাধ্যমে মহামারী থেকে বাঁচতে গ্রাম বন্ধ করতেন আগে। গ্রামে প্রবেশের পথে মাটি-শণদিয়ে উঁচু করে কয়েক স্তরের‘কুশি’ বানিয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য গ্রামেকে বিচ্ছিন্ন কওে রাখা হয়। ত্রিপুরা আদিবাসীরা মহামারী থেকে সুরক্ষা পেতে কের পূজা আয়োজন করেন। ¤্রােরা আগের দিনে মহামারীর সময় গ্রাম বন্ধ করে ঘরের ভেতর সময় কাটাতেন এবং অশুভ থেকে বাঁচতে আয়োজন করতেন তাংসাকপ্লাই কৃত্য পরিবেশনা। বসন্ত, হাম, কলেরা মোকাবেলায় শীতলা ও ওলা বিবির মতো নানা পূজাকৃত্য আয়োজিত হয় সমতলের আদিবাসীজীবনে। মহামারী সামাল দিতে কোচ-বর্মণ আদিবাসীরা গেরাম পূজার মাধ্যমে গ্রাম বন্ধ করেন কয়েকদিনের জন্য। মহামারী থেকে বাঁচতে আদিবাসী জীবনে এসব কৃত্য ও আচার একদিনে তৈরি হয়নি। এসব কৃত্যরীতির ঐতিহাসিক খতিয়ান আছে। মহামারী থেকে বাঁচার আদিবাসী জীবনের লোকায়ত শিক্ষা হলো ‘সাময়িকবিচ্ছিন্নতা’ ও ‘সঙ্গনিরোধ’। আর চলতি করোনা সংকটে বিশ্ব আজ এই বিধিগুলোই মানছে।
৫.
প্রশ্ন হলো মহামারী সামাল দেয়ার লোকায়ত ঐতিহাসিক প্রথা ও স্মৃতি থাকলেও দেশের সব আদিবাসী সমাজ কী তা পালন করতে পারছেন? দারুণ ভাবে বদলে যাওয়া বাস্তবতা এবং প্রান্তিকতার ধরণ এসব রীতি পালনে সকলকে সক্রিয় করে তুলছেনা। দিন এনে দিন খাওয়া কার্যত ভূমিহীন গরিষ্ঠভাগ আদিবাসীজনের পক্ষে বিচ্ছিন্নতা আর সঙ্গনিরোধ করে জীবন বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। করোনা মোকাবেলায় রাষ্ট্র দেশের প্রান্তজনে রজন্য বিশেষ সহায়তা কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দেশের নানা প্রান্তের আদিবাসীরা কী এর আওতায় সকলে ঠাঁই পাবেন? চলছে বসন্তকাল, আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন এ সময় প্রকৃতি সন্ধিক্ষণে থাকে আর নানান অসুখ বিসুখ ছড়িয়ে যায়। এ সময় পরিচ্ছন্ন ও শুদ্ধ থাকতে হয়। বাহা ও সারুল আয়োজিত হয় এ সময়েই। আদিবাসী সমাজ অপেক্ষা করছে চৈত্রসংক্রান্তির। চইতবিশমা, বিষু, বিজু, সাংগ্রেই, সাংগ্রেং, বৈসুক, চইতপরব, দন্ডবর্ত, চড়কপূজা কী এবার হবে? বোরোধান কাটার মওসুম চলে আসছে। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা এদিনের অপেক্ষা করে, পাহাড়ে জুমের প্রস্তুতির। করোনাসংকট কত দীর্ঘ হবে এমন শংকা ও হতাশা তৈরি হচ্ছে জনেজনে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দেশের সকল মানুষের অংশগ্রহণ কে নিশ্চিত করেছে। আশা করি করোনা মোকাবেলার তৎপরতায় আদিবাসীজনগণ কোনোভাবেই পেছনে পড়ে থাকবেনা। শংকা ও দুশ্চিন্তার ঘের থেকে মুক্ত হবে বিশ্ব। করোনা মোকাবেলায় সক্রিয় হবে আদিবাসী তৎপরতাও।
……………………………………………………………………
লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: animistbangla@gmail.com