করোনাকালে অকরুণ গুজব!
করোনাকাল মোকাবেলায় বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন সুনামগঞ্জ জেলার পক্ষ থেকে চিকিৎসাপত্র ও নগদ অর্থ প্রদানের জন্য আজ আমরা গিয়েছিলাম গুজব নির্ভর প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। সুনামগঞ্জ জেলার কাঠুরীয়া ইউনিয়নের কলাইয়া গ্রাম! সাথে ছিলো সুনামগঞ্জ বিএমএ’র সাংগাঠনিক সম্পাদক ডা. সৈকত দাস।
আমাদের সাধ্যমত গ্রামের প্রতিটি ঘরে গিয়েছি। রোগি দেখে প্রেসক্রিপশনসহ ওষুধ ও খাবার কেনার জন্য কিছু টাকা-পয়সা দেয়ার চেষ্টা করেছি।
প্রথমে গ্রামে ঢুকেই বিরাট অবাক হতে হয়েছে। চিকিৎসক, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসাসেবা নিয়ে সবাই গুজবের উপর দিনাতিপাত করছে।
প্রথম প্রথম আমাদের দেখামাত্র সবাই নিজ নিজ ঘরের দরজার খিল লাগিয়ে নিশ্চুপে ভেতরে অবস্থান করে নিচ্ছে। স্থানীয় এক কাজি সাহেব এবং এক সমাজকর্মীকে সাথে নিয়ে কয়েকটা মুমূর্ষু রোগি দেখলাম। তাদের সহায়তায় এরপর শুরু হলো আমাদের কাজ। প্রতিটা ঘরে ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি এবং রোগি দেখার পাশাপাশি অসহায় গরীবদের সাধ্যমত নগদ টাকা প্রদান করার চেষ্টা করেছি।
প্রাথমিকভাবে যারা ভয়ে দরজার খিল লাগিয়েছিলো তারাও একসময় ক্রিটিকেল সব রোগি নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে।
সত্যি বলতে কি, করোনা ভাইরাসের কারনে সরকারী চিকিৎসাসেবার মান যেমন সংকোচিত হয়ে গেছে, তেমনি বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারেও চিকিৎসা সেবার মান অনেকাংশেই কমে আসছে। ফলশ্রুতিতে করোনা আক্রান্ত রোগির বাইরে যে লক্ষ লক্ষ মুমূর্ষু রোগি আছে তারা মারাত্মক বিপদে পরতে যাচ্ছে।
তার সাথে যোগ হয়েছে নানান প্রকার গুজব। যেমন আমরা যে গ্রামে গিয়েছিলাম সে গ্রামের ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধা, বনিতা সবাই গুজব নির্ভর হয়ে পরেছে। কয়েকটি গুজব যেমন-
-‘অসুখ হলে কাউকে প্রকাশ করা যাবে না! প্রকাশ করলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, আর বাড়ি আসা যাবে না!’
-‘হাসপাতালে যাওয়া যাবে না! হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা ইনজেকশন দিয়ে সব রোগি মেরে ফেলতেছে!’
-‘চিকিৎসকের ওষুধ খেলে দেড় মাসের মধ্যেই মৃত্যু!’
-‘করোনা ভাইরাসে মারা গেলে কবর দিতে দিবে না।’
যাক আমরা ঐ গ্রামের গুজব দূর করে তাদের সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছি। হয়তো তাদের কিছুটা হলেও উপকার হবে। আসার সময় অনেক মুমূর্ষু রোগি রেখে আসতে হয়েছে, যাদের জীবন বাঁচাতে এই মুহুর্তে হাসপাতাল চিকিৎসা আশু প্রয়োজন!
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এই ভ্রান্ত ধারনা যদি সব গ্রামেরই একই হয়, তাহলে তো মহাবিপদ। করোনা ভাইরাস তাদের যতটা না ক্ষতি করবে, তারচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে অন্যান্য রোগ। ঐসব রোগের চিকিৎসা না করালে কি হবে, দৃশ্যটি ভাবলেই চোখে অন্ধকার নেমে আসে!
তাই আমাদের উচিত হবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সব ধরনের গুজব থেকে সাধারন মানুষকে সতেষ্ট করা।
এলাকার শিক্ষক, শিক্ষিত সমাজ বিশেষ করে তরুণরা, আলেম সমাজ, রাজননৈতিক ব্যাক্তিবর্গ, স্যোস্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, বেতার-টেলিভিশন, সবার কাজ হবে একযোগে বর্তমান কালের মহামারী করোনা ভাইরাসেরর সংক্রমণ ঠেকাতে সচেতনতার পাশাপাশি এলাকার মানুষকে সব রকমের গুজবের বিরুদ্ধে সচেতন করা, সজাগ রাখা। নতুবা বনের বাঘ দ্বারা মৃত্যু না হয়ে মনের বাঘ দ্বারা হয়তো আমাদের মৃত্যু হবে।
লেখকের ফেইসবুক থেকে)