মতি বাবু গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। নিজের কোন জমি নেই, অন্যের জমি চাষ করেন। এতে যা ফসল পান তার অর্ধেক জমির মালিক কে দিতে হয়, তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়েই কোনরকমভাবে সংসার চালান। পরিবারে এক ছেলে, তিন মেয়ে আর উনার স্ত্রী লক্ষী দেবী । মতি বাবু ছেলেমেয়ের ভরন পোষন করে, তাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে অনেক দুভোর্গ পোহান। অভাবের কারনে অনেক মেধাবী হওয়া স্বত্তেও বড় মেয়ে মোহনার উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেলো। মতি বাবুর দ্বিতীয় সন্তান একমাত্র ছেলে সূর্য নবম শ্রেণিতে আর দ্বিতীয় মেয়ে অর্পণা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সবার প্রিয় ছোট মেয়ে সূচি সবেমাত্র তিন বছরে পা দিলো। বড় মেয়ের অনেক গুন ছিলো, সে কাজে কম্মে ও দেখা শুনায় যেনো কোন দেবী প্রতিমা স্বরুপ ছিলো। মোহনা সেলাইয়ের কাজ জানতো কিন্তু একটা সেলাই মিশিন কেনার সাধ্য ছিল না তার। অনেক বার বাবার কাছে আবধার করেছে, বাবা বলেন দেখিরে মা কিছুদিন যাক যদি ব্যাংক ঋন পরিশোধ করতে পারি তো নতুন করে একটা বড় লোন নেবো। মোহনা বাবার কথায় মনে শান্তি পায়, যাইহোক এখন থেকে অন্যের মিশিনে কাজ করতে হবে না। বয়স তার বেশি হলে পনেরো কি ষোল হবে কিন্তু শারিরিক ঘঠন দেখে মনেহয় যেনো প্রাপ্ত বয়স্ক একজন পরিপূর্ণ নারী। অনেক পরিশ্রমী ছিল মোহনা, পরিবারের সব কাজ একাই করতো। অবসরে সেলাই করতো না হয় ছোট বোন সূচির সাথে খেলা করতো। সূচির মুখের আদু আদু বোল শুনতে খুবই চমৎকার লাগে, মোহনা যা বলে সূচি কেবলই তা অনুকরণ করার চেস্টা করে। অর্পণা প্রায়শই লক্ষ্য করতো দিদি তার বই গুলো পড়ছে, সে বলতো দিদি তুমি স্কুলে যাও না কেন? জানো দিদি স্কুলে আমরা অনেক মজা করি, আমি ও আমার বান্ধবীরা মিলে টিফিন খাই, মনের সুখে গান গাই গল্প করি। মোহনা চোখের জল মুছে আর বলে তুই লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবি, আমাদের পরিবারের কস্ট লাগব করবি! অর্পণা দিদি কে জরিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, অভাবের কারনে বাবা তোমার পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছেন! আশির্বাদ করো দিদি আমি যেনো তোমার স্বপ্ন পূরন করতে পারি, মা বাবার মুখে হাসি ফুঠাতে পারি। তখন সূর্য হঠাৎ করে ঘরে ঢুকলো, লক্ষ্য করলো যে তার প্রানপ্রিয় দিদি কাঁদছে! সে কোন কিছু না বুঝেই ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল অর্পণার গালে, বলল তরে কত বার নিষেধ করেছি দিদি কে কিছু বলবি না! মোহনা তখন সূর্য কে জরিয়ে ধরে বলল লক্ষিসোনা ভাই আমার, অর্পণা কে আর কখনও মারিস না। ও আমায় কিচ্ছু বলেনি, আমার চোখে কি জানি পরছে ভাই বার বার চুলকায় আর পানি আসে। সূর্য বলে ঠিক আছে দিদি আর কখনওই অর্পণা কে মারবো না কিন্তু তুমি কখনওই কাঁদবে না কথা দাও! মতি বাবু প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তিনি জমিতে বীজ বপন করেছেন, দিনরাত পরিশ্রম করেন। উনার ছেলে সূর্য বলে, বাবা আমরা যে এত কস্ট করে দিন রাত নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমিতে সোনালী ফসল ফলাই। তাতে কি লাভ হয়? সবশেষে জমির মালিক তো অর্ধেক ফসল নিয়ে যায়। আমি কিন্তু এই বছর একটা ধানও কাউকে দেবো না বাবা আগেই বলে রাখলাম। মতি বাবু বললেন তা কি হয়রে বাপ! আমরা তো গরীব চাষা অন্যের জমিতে ফসল ফলাই। তারপর জমির মালিক খুশি হয়ে যা দেয় তা হাসিমুখে নিতে হয় বাপ! ছেলে বলে না বাবা এই বার ধান বিক্রি করে দিদির বিয়ে দেবো ধুমধাম করে। আমাদের অভাবের সংসারে দিদি দিন রাত পরিশ্রম করে, একটা ভালো পরিবার দেখে দিদির বিয়ে দেবো বাবা। দিদির সুন্দর মুখটা দিন দিন কেন জানি মলিন হয়ে যাচ্ছে, তুমি এবার আর না বলো না বাবা। মতি বাবু ছেলের আবদারে সম্মতি দিয়ে বলেন, এইবার অনেক শ্রম দিতে হবে জমিতে। জমিতে সময় মতো পানি সেচ দেয়া, সার দেয়া ও পরিচর্যা করতে হবে। জমির খরচের জন্য অনেক টাকা ধার করতে হলো, বাপ ছেলে দুইজনে মিলে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকে। মতি বাবু ব্যাংক লোন তুললেন কিন্তু ধার শুধ করার পর হাত শূন্য, এবার ও মোহনার সেলাই মিশিন কেনার স্বপ্ন পূরন হলো না! দেখতে দেখতে বৈশাখ চলে আসলো চারদিকে নতুন ধানের গন্ধে মন প্রান জুরিয়ে যায়। সূর্য অনেক খুশি হয়ে বলে বাবা মাতা বসুমতী এবার সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের দ্বিগুন ফসল দিয়েছেন। এবার যদি ঠিকঠাক মতো ঘরে তুলা যায়, আমাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। ধান পাকা শুরু হতে না হতেই প্রকৃতি তার বিরূপ আচরন শুরু করলো, চারদিকে প্রচন্ড বেগে কালবৈশাখী ঝড় সাথে শিলা বৃষ্টি শুরু হলো। সূর্য চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে হে পরম করুনাময় “সৃষ্টিকর্তা তুমি সর্বশক্তি মান” তোমার সৃষ্টি তুমি রক্ষা করো প্রভু। মতি বাবুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো! গালে হাত দিয়ে ভিষন্ন বদনে বাকরুদ্ধ হয়ে চুপটি করে ঘরের এক কোনে পরে রইলেন। উনার সব থেকে আদরের ছোট মেয়ে সূচি, অর্পণা ও লক্ষী দেবী উনার পাশে বসে কাঁদতে থাকে। তখন মোহনা সূর্য কে বুকে জরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরো বলে ভাই শান্ত হয়, সব ঠিক হয়ে যাবে। সূর্য চিৎকার করে কান্না জরানো কন্ঠে বলে, ফসল না তুললে অনাহারে মরবো দিদি। আমাদের হাড় ভাঙা পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে গেলো দিদি, আমাদের সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেলো দিদি! দুই চার দিন পর ধান কাটা শুরু হলো কিছু জমির ধান কাটা শেষ হতে না হতেই কালবৈশাখীর তান্ডবে প্রচন্ড বেগে পানির স্রোতধারা বইতে শুরু হলো নদীতে। দেখতে দেখতে চোখের নিমিষেই সবকিছু একাকার হয়ে গেলো। সূর্য ধানের বস্তা নিয়ে পানির মধ্যে হাবু-ডুবু খেতে থাকে, মতি বাবু চিৎকার করে ছেলে কে ডাকেন সূর্য কইরে বাপ। তখন সামনে দেখতে পান সূর্য ডুবে যাচ্ছে তবোও ধানের বস্তা ছাড়ছে না, এসব ছেড়ে দে বাপ আয় নৌকায় আয় বলে টেনে তুললেন নৌকার উপর। সূর্য বলে বাবা এবার তো আমরা না খেয়ে মরবো কেনো বাঁচালে আমায়! কালবৈশাখী মতি বাবুর জীবনে অভিশাপ হয়ে শক্তি সেলের মতো তার বক্ষে আগাত করলো। কাল বৈশাখীর জন্য সূর্যের স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেলো, দিদির বিয়ের অনুষ্ঠান হৈ হুলুর কিছুই হলো না। সবকিছু শেষ করে দিলো কালবৈশাখীর কালসাপ, অভিসপ্ত করে দিলো সূর্য পরিবার কে! সবশেষে জমির মালিক ধান নিতে আসলেন, সূর্য বলে বাবা যা আছে তা দিয়ে আমাদের কয়েক মাস যাবে। তুমি যদি অর্ধেক ধান দিয়ে দাও, আমাদের কে তো উপুস মরতে হবে! মতি বাবু বলেন বাপধন আমার যদি অর্ধেক ধান না দেই, আগামী বছরের জন্য।
মতি বাবু বলেন বাপধন আমার যদি অর্ধেক ধান না দেই, আগামী বছরের জন্য জমি পাবো না। তখন কোথায় দাঁড়াবো আমরা, সূর্য বাবার বুকে নিজেকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে কাঁদে। সূর্য বলে বাবা সৃষ্টিকর্তা কেন বার বার আমাদের এত কস্ট দেন!
মতি বাবু আবারো তার পরিবারের জন্য জমি বর্গা নিলেন।