জায়েদ চৌধুরী অপু ::
একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল লক্ষ-কোটি প্রাণে, পাকিস্তানিরা তা অনুধাবন করতে পারে তাই ২৫শ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙ্গালী নির্মম ভাবে হত্যা করে । ২৬ মার্চ থেকেই সারা দেশে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করে বীর বাঙালি। পরবর্তী ইতিহাস বীর মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস। একই সময় সুনামগন্জে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ । দেওয়ান ওবায়েদ রেজা চৌধুরীর বাসায় আওয়ামীলীগ , ন্যাপ ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ সভায় ১৫ সদস্যের এই পরিষদ গঠন করা হয়। মরহুম আছদ্দর আলী চৌধুরী উক্ত পরিষদের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। তারই অংশ হিসাবে সুনামগন্জ সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ সুনামগন্জ শহরে বীরর জনতাকে সংঘটিত করে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন । ১০ই মে সংগ্রাম পরিষদ শেষ সদস্য হিসাবে তিনি , জনাব আলফাত ঊদ্দিন আহমেদ এবং জনাব নজির হোসেন শহর ত্যাগ করেন । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পরিবারের সাথে তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন ছিলেন ।উনি জানতেন না কে কোথায় আছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক বাহিনী তাঁর সুনামগঞ্জ শহরের বাড়ীটি ধ্বংস করে দেয়। মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যেক্ষ্য এবং পরোক্ষভাবে পাকবাহিনীর সম্মুখীন হন প্রত্যেকবার আল্লাহতালার অশেষ মেহেবানীতে পাকবাহিনীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সম্মত হন ।পরবর্তীকালে বালাট আনসার শরনার্থীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং দেশ স্বাধীনতা লাভের পুর্বদিন পর্যন্ত লালপানি শরনার্থী শিবিরে রিলিফ কমিটির সভাপতি হিসাবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। একজন সফল মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সম্মিলিত ভাবে দেশের জন্য স্বাধীনতার পতাকা বয়ে আনতে সক্ষম হন ।
স্বাধীনতার পর সুনামগন্জ মহকুমার রেডক্রসের সাধারন সম্পাদক হিসাবে তিনি তিনবছরের বেশী সময় সুনামের সহিত তাহার উপরঅর্পিত দায়িত্ব সকল প্রকার স্বজনপ্রতির ঊর্ধ্বে থেকে পালন করেন, এমন কি ঘরের মধ্যে ছোট ছেলে -মেয়ে থাকা স্বত্তেও পরিবারের জন্য কোন প্রকার সুবিধা গ্রহন করেননি। সরকারি নির্দেশ মোতাবেক প্রকৃতভাবে যাদের প্রয়োজন তাদের তালিকা তৈরী করে নিজ হাতে গরীব এবং সর্বস্বান্ত জনগনের সেবা করে গেছেন। পেশায় একজন আইনজ্ঞ হয়েও দেশের প্রয়োজনের আইনপেশা বাদ দিয়ে সাধারণ জনগনের সেবা করে গেছেন।পরিবার থেকে দেশ বড় এই মানসিকতা নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সংসদের অন্যতম সংঘটক হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দায়িত্ব পলন করেন।১৯৭৩ সালে সুনামগন্জ মহকুমার আওমীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৩ সালে সুনামগন্জ ৫ আসনের বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নমিনেশন পাওয়া সত্বেও বৃহত্তর দলীয় স্বার্থ বিবেচনা করে নির্বাচন থেকে বিরত থাকেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে বাকশালের সম্পাদক নির্বাচিত হন । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু সপিরবারে নিহত হওয়ার প্রতিবাদ করায় তথকালীন সামরিক সরকার ১৭ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে উনাকে আটক করে এবং ৩ মাস পর ২১শে নভেম্বর ১৯৭৫ সালে মুক্তি লাভ করেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে তিনি সুনামগন্জে মহকুমা আওয়ামী লীগ কোষাধক্ষ্য হিসাবে দায়িত্ব পলন করেন।
পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসাবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দলের জন্য বলিষ্ট ভুমিকা রাখেন এবং রাজনীতিতে পেশীশক্তির আভির্ভাব হতে দেননি । পারিপার্শ্বিক অবস্থা কারনে শেষ জীবনে রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিলেন । জীবনে তিনি কখনও অন্যায়ে কাছে মাথা নত করেন নাই এবং সবর্দাই অন্যের উপকারে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন ।তিনি আজীবন সুনামগন্জ বার লাইব্ররীর সদস্য ছিলেন । সাথে সাথে সুনামগন্জ পাবলিক লাইব্রেরী এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের আজীবন সদ্যস্য ছিলেন এবং নিষ্টার সাথে অর্পিত দ্বায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেন। উনার শখের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মাছ শিকার করা এবং বাগান করা। বাগানে সব্জি নিজে খাইতেন এরমধ্য আত্মীয় স্বজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের বিতরন করে আনন্দ পেতেন।
মৃত্যুর পূর্ব পযন্ত সুনামগন্জ জেলা আদালতে একজন দক্ষ্ আইনজীবী হিসাবে অত্যন্ত সুনামের সহিত ফৌজদারী আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন।এবং গরীব জনগন যারা মামলা করতে আসতেন তাদেরকে বাসায় জায়গা দেওয়া সহ বিনা পয়সায় মামলা পরিচালনা করতেন। তখনকার সময় অনেক মক্কেল বাসার সন্নিকৃত কামালখালে নৌকা রান্নাবান্না করে উনার নিকট অত্যান্ত স্বল্প মূল্যে আইনি পরামর্শ নিতেন ।
৩১ জুলাই ১৯৯৮ সাল রোজ শুক্রবার বেলা ১৩.১৫ মিনিটে সুনামগন্জে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। মরহুম আছদ্দর আলী চৌধুরীর সহধর্মিনী বেগম হাসনা চৌধুরী। স্বামীর সামাজিক কর্মকান্ড দেখে যিনি নিজেকে সমাজের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন এবং হয়ে উঠেছিলেন একজন সমাজ সেবিকা। তিনি একজন আদর্শ মাতাও। তাঁর প্রতিটি সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত । ২০০৯ সালে তিনি সিলেট রত্ন ফাউন্ডেশন কর্তৃক রত্নগর্ভা মা এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত হন। তাঁর পরিশ্রমে সংসারের দায় দায়িত্ব কখনো অবহেলায় পড়ে থাকেনি। সন্তানদের মানুষ করার পাশাপাশি স্বামী সন্তানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন অকাতরে।
চৌধুরী আবু কয়সর দীপু। মরহুম আছদ্দর আলী চৌধুরী তৃতীয় সন্তান, পুলিশ অফিসার ছিলেন (সিটি এসবি’র সিআইও-০১)। তিনি কর্তব্যরত অবস্থায় সিলেট শিববাড়ীতে জঙ্গী হামলায় শহীদ হন । পিতার আদর্শে গড়া দীপু ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, ধার্মিক ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। আমেরিকার ডিভি লটারীতে গ্রিনকাড পেয়েও শুধুমাত্র দেশের টানে ফেরত আসেন।তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আইভরি কোস্টে শান্তিরক্ষায় প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন ।
মরহুম আছদ্দর আলী চৌধুরী অন্যান্য সন্তানরা
উচ্চ শিক্ষিত হয়ে দেশে বিদেশে মানব কল্যানে দায়িত্ব পালন করছেন । উনার অন্যান্য সন্তানরা হলোঃ-
চৌধুরী মোহাম্মদ আবু সাঈদ (স্বপন) বি.কম (সম্মান) ,এম.কম (হিসাব বিজ্ঞান) এল,এল,বি (বর্তমানে ডি এম ডি, বিজিআইসি প্রধান কার্যালয়, ঢাকা।)
চৌধুরী মোহাম্মদ আবু তারেক (সাজু), বি.এসসি (অনার্স)এম.এসসি (পরিসংখানে),ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । এল.এল.বি (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী)
চৌধুরী মোহাম চৌধুরী মোহাম্মদ আবু জায়েদ (অপু) এম.কম সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা(বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী NYCT তে কর্মরত)
চৌধুরী মোহাম্মদ আবু উবায়েদ, বিএসসি ইন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়,(বুয়েট) ঢাকা। (বর্তমানে নির্বাহী প্রকৌশলী, পিডিবি সিলেট)
চৌধুরী মোহাম্মদ আবু জাবেদ(নিপু) বি.কম (ব্যবসায়ী, ঢাকা)
চৌধুরী মোহাম্মদ আবু সাহেদ (বাবলু) এম.এ , এল এল বি (বর্তমানে প্রধান শিক্ষক , সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুনামগন্জ)
ফেরদৌসী চৌধুরী ইভা (ফ্রান্সে প্রবাসী)