বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন হয়নি বলে অভিযোগ ওঠেছে। দু’দফা সময় বাড়িয়ে ৩১ মার্চ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ বাঁধগুলোতেই দায়সারা মাটি ভরাট করে কাজ সেরেছিল প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। এবার মওসুম ভালো থাকায় এবং রুদ্র পৃকতি সদয় থাকায় সুরক্ষা বাঁধ ছাড়াই পুরো ফসল কাটতে সক্ষম হচ্ছেন কৃষক। এখন বরাদ্দের অবশিষ্ট ৫২ কোটি টাকা উত্তোলন করতে মনগড়া পোস্ট এসেসমেন্ট করার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। তাছাড়া পোস্ট এসেসমেন্ট করতে ধানকাটাকে অজুহাত হিসেবে সামনে নিয়ে আসলেও মূলত বন্যার অপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ কৃষকরা। বন্যা আসলে যাতে আলামত মুছে যায় এবং পুরো বরাদ্দ উত্তোলন করা যায় সেই চেষ্টাই চলছে-এমন মন্তব্য করেছেন কৃষক নেতৃবৃন্দ।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে চলতি বছর জেলার ছোট বড় ৫২টি হাওরের ফসলরক্ষা বাধ নির্মাণে প্রাথমিক ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ িেছল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পাউবোর উপ-সহকারির নেতৃত্বে প্রতিটি উপজেলায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যার ফলে ৬৯ কোটি টাকার বাজেট এক সময়ে ১৩২ কোটি টাকায় দাড়ায় অপ্রয়োজনীয় বাঁধের কল্যাণে। ৬৩৬ কি. বাধ মেরামত, সংস্কারে প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ৭৪৯টি প্রকল্প। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ এমনকি স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বাধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ করার কথা ছিল। ওই সময়ে প্রকল্পই গ্রহণ শেষ হয়নি। ৩১ মার্চ পর্যন্ত দুই দফা সময় বাড়ানো হয়। অভিযোগ রয়েছে ৩১ মার্চ পর্যন্ত কোনরকমে মাটির কাজ করলেও বাঁধের কমপেকশন, দুর্বাঘাস লাগানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা সম্ভব হয়নি। করোনার কারণে দায়িত্বপ্রাপ্তররা বাঁধে নজর দিতে পারেননি ওই সময়। যার ফলে গত সপ্তাহের হাল্কা বৃষ্টিতেই অনেক বাঁধ ধসে গেছে। ভারী বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢল হলে এবার সহজেই বাঁধ ভেঙ্গে ফসলহানীর ঘটনা ঘটতো এমন আশঙ্কা ছিল। তবে এর মধেই পুনপ্রাক্কলিত ১৩২ কোটি টাকার ৬০ ভাগ বিল তুলা হয়েছে। বাকি ৫২ কোটি টাকা তুলে নিতে উপজেলা পর্যায় থেকে পোস্ট এসেসমেন্ট করে মনগড়া বিল তুলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে ধানকাটার কারণে পোস্ট এসেসমেন্ট করতে পারছেনা উপজেলা কমিটি। তবে জেলা কমিটি এর আগেই মাটির মেজারমেন্ট করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে কৌশলে। কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতারা বলছেন মূলত বন্যার অপেক্ষা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বন্যা আসলেই মনগড়া পোস্ট এসেসমেন্ট করে বিল জমা দিয়ে পুরো বিল হাতিয়ে নেবার চেষ্টা চলছে।
গত ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার বিভিন্ন হাওর এলাকা পরিদর্শন করে হাওর আন্দোলনের সংশ্লিষ্ট ‘হাওর এডভোকেসি ফোরাম’ (হ্যাপ) সুনামগঞ্জে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন হাওরের বেশিরভাগ বাঁধেই দুর্বাঘাস লাগানো হয়নি। প্রতিযোগিতা করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাড়িয়ে অর্থ নয়ছয়ের প্রবণতা এবার ভয়াবহ ছিল বলে জানিয়েছে তারা। হাওর বাঁচাও আন্দোলন ১৮ মার্চ বৃহষ্পতিবার শাল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে হাওররক্ষা বাঁধ পরিদর্শন করে দুর্বাঘাস লাগানোর প্রমাণ খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছিল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় অপ্রয়োজনীয় ৩ শতাধিক প্রকল্প নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাওর বাচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
পাগনার হাওরের কৃষক নেতা বিন্দু তালুকদার বলেন, আমাদের উপজেলায় সব প্রকল্পের মাটি কাজই শেষ করা হয়নি ভালোমতে। কেথাও দুর্বাঘাস লাগানো হয়নি। এবার মওসুম ভালো থাকায় কাজ না করিয়েই সংশ্লিষ্টরা খুশিতে আতœহারা। তিনি বলেন, ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল হলে এবার এক ধাক্কায়ই বালির বাধ ভেঙ্গে যেতো। প্রকৃতি এবার পিআইসিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
হাওরবাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেনরায় বলেন, প্রতিযোগিতা করে এবছর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। আমরা পানিসম্পদ মন্ত্রীকেও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের সময় ৩ শতাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের বিষয়ে অভিযোগ করেছিলাম। তারপরেও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রকল্পের পুরো কাজ না করিয়েই তিন দফা ৬০ ভাগ বিল দেওয়া হয়েছে। এখন বন্যার অপেক্ষা করা হচ্ছে পোস্ট এসেমেন্টের জন্য। যাতে বাকি ৪০ ভাগ বিল তুলে নেওয়া যায় সহজে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও জেলা বাঁধ নির্মাণ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব মো. সবিবুর রহমান বলেন, আমরা উপজেলা কমিটিগুলোর পোস্ট এসেমেন্ট এর অপেক্ষায় আছি। তারা বৈশাখি ধানকাটার ঝামেলার কারণে পোস্ট এসেসমেন্ট করতে পারছেন না। তবে উপজেলা কমিটি থেকে পোস্ট এসেসমেন্ট পাঠানো হলেও জেলা কমিটি যাছাইবাছাই করে বিল দিবে। পানি আসার পর বিল জমা দিলে কিভাবে যাছাই করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতেও কোন সমস্যা হবেনা। কারণ মাটির মেজারমেন্ট করা আছে।
জেলা বাঁধ নির্মাণ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, উপজেলা কমিটির পোস্ট এসেসমেন্ট যাছাই করা হবে কঠোরভাবে। তাদের পাঠানো চূড়ান্ত বিল যাছাই না করে দেওয়া হবেনা।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধীদলীয় হুইপ এডভোকেট ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, করোনার কারণে এবার শেষ দিকে বাধের কাজে নজরদারি কম ছিল। তাছাড়া অনেক বাঁধেই প্রাক্কলণ অনুযায়ী কাজ হয়নি বলে কৃষকরা আমাদের অভিযোগ করেছেন। তাছাড়া কাজে ও প্রকল্প গ্রহণেও বিতর্ক ছিল। তাই সরকারি বরাদ্দ যাতে অপচয় না সয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি যেন থাকে।
ছবিটি: সদর উপজেলার ডাকুয়ার হাওরের দেওয়াননগর এলাকা থেকে তুলা। এবারের ফসলরক্ষা বাঁধ। দূর্বা লাগানো হয়নি। অল্প বৃষ্টিতেই দেবে যাচ্ছে।