মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কাজ করেছেন আজীবন । তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সক্রিয় । তিনি ছিলেন সুনামগন্জ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। তখন সুনামগন্জ ছিল মহকুমা সদর আর সিলেট ছিল জেলা। এখনকার মতো, সেই সময়েও ছাতক সুনামগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা / উপজেলা ছিল। জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী ছাতকের ছৈলা -আফজালবাদ ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে ছৈলা গ্রামে একটি সম্মানিত ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিখ্যাত আইনজীবী আলহাজ্ব মফিজ চৌধুরী এবং বিখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ মুসলিম চৌধুরীর ভাতিজা। তারা সকলেই মূলত একই পরিবারের সদস্য ছিলেন ।
জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী এবং আমার বাবা প্রয়াত যামিনী কান্ত দেব এর মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট। জনাব চৌধুরী উনাকে কাকা বলে সম্বোধন করতেন। দুজনই সুনামগঞ্জ আদালতের আইনজীবী ছিলেন, যদিও আমার বাবা দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালতে প্র্যাকটিস করতেন, তবে তিনি মূলত প্র্যাকটিস করতেন ফৌজদারী আদালতে। জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী ফৌজদারী আদালতে অত্যন্ত সফল ছিলেন। বাস্তবে আইনজীবী হিসাবে জনাব চৌধুরী ছিলেন সৎ এবং দক্ষ। তিনি বক্তব্য রাখতেন পয়েন্ট টু পয়েন্ট ,তাঁর হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর ।তিনি প্রথমে মুক্তার এবং পরে উকিল হন। ১৯৭৪ সালে আমি যখন আইনজীবী হিসাবে যোগদান করি তখন তিনি আমাকে অনেক উৎসাহিত করেন। জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরীর বাসা সুনামগন্জের নতুন পাড়া এলাকায়। তাঁর লাইফ স্টাইল ও পোশাক-আশাক ছিল অত্যন্ত সাধারণ। তাঁর দুটি বিশেষ শখ ছিল, একটি হ’ল শীতকালে সব্জীবাগান করা এবং অন্যটি বর্ষাকালে মাছ ধরা। তিনি ফুল কপি ও বাধা কপি চাষ করতেন ( তখনকার সময় এগুলো সুনামগঞ্জের বাজারে পাওয়া যেত না)। তিনি সব্জি ও মাছ আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করতেন।
জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরীর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান / পূর্ববাংলার বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি ভালবাসা ছিল গভীর। তিনি তখনকার আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ।তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তখনকার সময়ের কিছু রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করতে চাই । ইস্কান্দার মির্জাকে উৎখাত করে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক আইন জারির করেন । জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহ ভেঙে দেওয়া হয়, রাজনৈতিক দলসমূহ বিলুপ্ত করা হয়, মৌলিক অধিকারসমূহ কেড়ে নেয়া হয় । শুরু হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য । বাঙালিদের উপর নিপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে , অনেকটা পূর্ব বাংলা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশের মতো । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির পক্ষে আন্দোলন ও প্রতিবাদ করতেন। তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করেন । জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী ও সুনামগঞ্জের অন্যান্য নেতারা মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরেন । সেই সময়ে রাজনীতিক কার্যকলাপ ছিল অনেক ঝুঁকিপূর্ণ , তারপরও জনাব চৌধুরী এবং অন্যান্যরা সাহসীকতার সাথে বৈষম্যের প্রতিবাদ করতেন , রাজনীতি করতেন ।
জেনারেল আইয়ুব খানের ১৯৫৯ সালে মৌলিক গনতন্ত্র প্রবর্তন করা । এই ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মোট ৮০ হাজার নির্বাচিত স্থানীয় সরকার এর সদস্য নিয়ে নিবার্চকমণ্ডলী গঠন হয়। তাদের ভোটেই রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয় ।অথাৎ পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হত ।ষাটের দশকে জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী সুনামগন্জ মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন । তিনি ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ।মিস ফাতেমা জিন্নাহ ছিলেন সম্মিলিত বিরোধী দলের (কপ) প্রার্থী । সুনামগঞ্জে জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী এবং অন্যান্য নেতারা মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে কঠোর পরিশ্রম করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে জয় লাভ করেন । নির্বাচনটি ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে ।
এই পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেছেন । ছয়-দফার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহর-বন্দর-গ্রাম- গঞ্জে সর্বত্র। সুনামগঞ্জে ছয় দফা পক্ষে ব্যপক প্রচারনা চালান জনাব চৌধুরী এবং অন্যান্য নেতারা ।
স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালে ছাত্ররা ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করেন। এতে আওয়ামি লীগের নেতারা পূর্ণ সমর্থন দেন। গণঅভ্যুত্থানের মুখে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং শেখ মুজিবসহ সব বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে পরদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিবের সম্মানে এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে শেষাবধি পাকিস্তানের ‘লৌহ মানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।সময়ের সাথে সাথে ইয়াহিয়া সরকার ১৯৭০ সালের নির্বাচন ঘোষণা করে। একই সময় বঙ্গবন্ধু সুনামগন্জে এসেছিলেন । বঙ্গবন্ধু বর্তমান সুনামগন্জ স্টেডিয়ামে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেন। দলে দলে জনসাধারণ এই সভায় যোগ দেয় । এই সভাকে সফল করার জন্য জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা কঠোর প্ররিশ্রম করেন ।তখন থেকে জনাব চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যশনাল এ্যাসেম্বলীতে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের ২৮৮টি জিতে নেয়।
ইয়াহিয়া খান জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর অস্বীকৃতি জানালে পূর্ব বাংলার জনগন রাস্তা নেমে আসে । শুরু হয় গণআন্দোলন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ।সেই রাতেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ ।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ । বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় ।একই সময় সুনামগন্জ শহরে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় । জনাব চৌধুরী ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য । সুনামগন্জের মুক্তি পাগল জনতা পাকিস্তানী বাহিনী বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাকিস্তানী বাহিনী সুনামগন্জ ছাড়তে বাধ্য হয় ।মে মাসের প্রথম সাপ্তাহে আবারও পাকিস্তানি বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুনামগন্জ আক্রমণ করলে জনাব চৌধুরী এবং অন্যান্য নেতারা মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যে মেঘালয়ের বালাটে চলে যান ।সেখানে উনারা মুক্তিপাগল জনতাকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন । জনাব চৌধুরী তখন সেখানে রিলিফ কমিটির সভাপতি হিসাবে কাজ করেন । তিনি ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা জানতেন । মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন । তিনি রেড ক্রস (বর্তমানে রেড ক্রিসেন্ট) সুনামগঞ্জের দায়িত্বে ছিলেন। যথাযথভাবে রিলিফ বিতরণ করুন। তিনি ছিলেন সৎ ও অসাম্প্রদায়িক। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ট্র্যাজেডির পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় । আমি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে জনাব চৌধুরীকে দেখতে গিয়েছিলাম ।
জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী আমাদের সাথে আর নেই, তবে তাঁর স্মৃতি আমাদের সাথেই থাকবে, তাঁর ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সাথে তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিল না, পরিবার অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। পাক সেনারা তাঁর বাড়ি পুড়িয়েছে। তাঁর স্ত্রীও একজন সমাজকর্মী এবং স্নেহময়ী মহিলা ছিলেন। তাঁর এক পুত্র “দিপু” ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার, যিনি সিলেটের শিববাড়িতে জঙ্গিদেরে বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ দেন । মরহুম চৌধুরীর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা ।
#
লেখক: স্বপন কুমার দেব। সিনিয়র আইনজীবী,জেলা জজ আদালত, সুনামগঞ্জ।