বিশেষ প্রতিনিধি::
গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষণ (টি.আর) কাবিটা কর্মসূচীর আওতায় গৃহহীনদের জন্য দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণে ২০১৯/২০২০ অর্থ বছরে ব্যপক স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম,ঘুষ বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে সুনামগঞ্জের শাল্লায়। একটি দুর্নীতিবাজ চক্রের কারণে সরকারের এই গণমুখি উদ্যোগ এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া যাচ্ছেতাই ঘর বানানোয় এখনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে ঘর নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্তরা উল্টো গরিবদের কাছ থেকে আরো অর্থ ও নির্মাণ উপকরণ আদায় করে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহার গরীব অসহায় গৃহহীনদের মধ্যে বিনামূল্যের ঘর নির্মাণ কাজ নিয়ে বিরম্ভনার শিকার হচ্ছে উপকারভোগীরা।
অভিযোগ উঠেছে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে উপজেলার ৪ ইউনিয়নে মোট ৩০ টি ঘর ২ লাখ ৯৯ হাজার টাকার বরাদ্দকৃত গরীবের ঘর বছর পেরিয়ে গেলেও ৩০ ভাগ কাজ এখনও শেষ হয়নি। আবার যেটুকু হয়েছে সেই কাজ ও খুবই নিম্নমানের, ফলে বাতাসেই দেয়াল ভেঙে যাচ্ছে। আবার কাজ কেন শেষ করা হচ্ছেনা জানতে চাওয়া হলে ঘর প্রাপ্ত অসহায়দের হুমকি দেয়ার ও অভিযোগ উঠেছে । এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার পেয়েও অসহায় দিন কাটাচ্ছেন ঘর প্রাপ্ত অনেকেই।
শাল্লা ইউপির আদিত্যপুর গ্রামের উপকারভোগী বিধবা অসহায় নারী কাজল রানী বলেন, শেখ হাসিনা আমরার মত গরীবের জন্য ১ বছর আগে ঘর দিছে। আর এই ঘরের এখনও অর্ধেক কাম (কাজ) অইছেনা। শুনছি চেয়ারম্যান ফুল মিয়া ঘর তৈরির সভাপতি। যেটুকু কাজ হইছে সেই কাজে আমি নিজেই দেনা করে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করেছি। তিনি বলেন চেয়ারম্যান কাজ করলে দেখবে কে? তারারে কাজ দিলে কাম ওইবো কেমনে। কোন কিছু বলতে গেলে ভয় দেখায় চেয়ারম্যান।
এরকম বাহাড়া ইউনিয়নের মির্জাকান্দা গ্রামের জরিনা আক্তারের স্বামী ইকবাল হোসেন বলেন, কি আর কমু আমি নিজে রডের পিলার দিছি, তার পর ও দেয়াল বাতাসের ঠেলায় ভাঙ্গিয়া পরছে। কাজ কবে যে শেষ করবে আল্লাহ জানেন। ভাঙা ঘরে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন বার বার চেয়ারম্যান বিধান চৌধুরীর কাছে গিয়েছি ঘরের কাজ শেষ করার জন্য তিনি আজ না কাল বলে সময় পার করছে। কাজের মান ও খুবই নিম্নমানের বলে জানান। পাশের মেদা গ্রামের সোনাফর আলীর ছেলে জীবানুর হাসানের ও একই অবস্থা । আটগাঁও ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের বিরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা জমিলা বেগম ও উজানগায়ের পিয়ারা বেগম উভয়ই বলেন, ডিসি স্যারের কথায় আমরা ঘর পাইছি। এখন ও ঘরের কাম অনেক বাকী রইছে। চেয়ারম্যানদের কাম করলে ভয়ে কিছু বলা যায়না। তারা উভয়েই বলেন সরকার যারে ঘর দিব টেকা তারে দিলে সে ব্যক্তিই তার ঘর করতে পারবে। নাইলে চেয়ারম্যানের পাছে পাছে ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ অইবো তাও গরীবের ঘরের কাম শেষ অইতোনা।
গৃহহীনদের ঘর পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে বলে উপজেলায় বিস্তর আলোচনা আছে। উপকারভোগীদের অনেকেই বলেছেন ঘুষের টাকা দিয়ে এর চেয়ে ভালো ঘর নিজেরাই তৈরি করতে পারতেন। গরিবদের জন্য ঘরগুলোর বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও টাকা পয়সা আছে এমন ব্যক্তিদের দেয়া হয়েছে বেশির ভাগ ঘর। দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে উঠে এসেছে এসব চিত্র। ঘর নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই এই দুর্নীতির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। বিশেষ করে কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ জোরালো।
হতদরিদ্রদের কষ্ট লাঘবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এ ঘরগুলো বিনামূল্যে বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ঘরপ্রতি ৩০ থেকে ৫৯ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে শাল্লায়। এনিয়ে কথা হয় শাল্লা ইউপি চেয়ারম্যান জামান চৌধুরী ফুল মিয়ার সঙ্গে তিনি বলেন আমি কাউকে হুমকি দেইনি। বিভিন্ন সমস্যার কারণে ঘর নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে। পিআইসিতে তিনি সভাপতি তবে সদস্য সচিব কে বা কারা জানেন না। উনাকে শুধু কাজ করার কথা বলা হয়েছে। বন্যার পর ঘরগুলোর কাজ করবেন বলে তিনি জানান।
ঘর নিয়ে কথা হয় বাহাড়া ইউপির চেয়ারম্যান বিধান চৌধুরীর সঙ্গে, তিনি বলেন মালামাল আনতে একটু বিলম্ব হওয়ায় ঘরের কাজ করতে সময় লেগেছে। এখন আবার কাজ শুরু করেছি। মির্জাকান্দর ঘরের দেয়ার ভেঙে পরার বিষয়ে তিনি জানান হয়তো কোন আঘাতে দেয়াল পরেছে সেটি মেরামত করা হবে।
এবিষয়ে কথা হয় আটগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম আজাদ এর সাথে। তিনি জানান তুলনা মাফিক আমার দায়িত্বে করা ৮ টি ঘরের কাজ ভালো হয়েছে এবং কাজ ও শেষ করেছি। তবে দুএকটি ঘরের ল্যাট্রিন এর রিংয়ের কাজ বাকী রয়েছে। সেগুলো তারাতারি শেষ করে দিব।
কথা হয় হবিবপুর ইউপির চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল এর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নে মোট ৬ টি ঘর আছে সেগুলো মেম্বারদের সভাপতি করে ঘর সম্পন্ন করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। উপকারভোগীদের অনেকেই ঘর নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ করছেন। তাদের মৌখিক অভিযোগ পেয়ে আমি সংশ্লিষ্টদের জরুরি বিত্তিতে ঘরের কাজ শেষ করার জন্য বলা হয়েছে ।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মুক্তাদির হোসেন এর সাথে ফোনে কথা হলে ঘর নির্মাণে বিলম্বের কথা শিকার করে বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও করোনা পরিস্থিতি জন্য কাজগুলো সমাপ্ত করা হয়ে উঠেনি। এখন দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শাল্লা উপজেলায় টিআর/কাবিটা কর্মসূচির আওতায় দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ প্রকল্পের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩০টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬০ টাকা। উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নের মধ্যে শুধু ২ নং হবিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান ব্যতিত বাকী ৩ চেয়ারম্যান স্ব স্ব ইউনিয়নের ঘর নির্মাণে পিআইসির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
আটগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম আজাদকে পিআইসির সভাপতি করে ৮ টি, বাহাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিধান চৌধুরীকে সভাপতি করে ৮ টি, শাল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামান চৌধুরীকে ৮ টি ঘরের পিআইসির সভাপতি করে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং হবিবপুর ইউনিয়নে ৬ টি ঘর তৈরির জন্য ওয়ার্ড সদস্যদের সভাপতি করে ঘর নির্মাণ করার কথা রয়েছে। এর পুর্বে ৭২ টি ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা মুল্যের ঘরের কাজ হয়েছে সেগুলো ও সম্পুর্ন ভাবে কাজ সমাপ্ত হয়নি। উপকারভোগীদের দাবী প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের ঘর সুচারু রূপে নির্মাণ করার জন্য সংশ্লিষ্টরা সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন।