জন্মের পর একটি শিশু ধীরে ধীরে বাবা মায়ের কুলে অতি আদরে বেড়ে উঠে। একটি নির্দিষ্ট বয়সে তাকে লেখাপড়া শেখানোর জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হয়। অনেকেই তিন বছর বয়সে কিন্ডারগার্টেনে ( কেজি) প্লে গ্রুপে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দেন। যদিও আমাদের দেশে সরকারি ভাবে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির বয়স পাঁচ বছর। শিশুকে কম বয়সে অনেকেই ভর্তি করিয়ে থাকেন মূলত জানার বা শেখার চেয়ে তাকে চাকুরীর বাজারে উপযুক্ত প্রতিযোগি হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে। এই বয়সে শিশুদের উপর মানসিক চাপ এক ধরনের নির্যাতনের শামিল। এটা নিয়ে সরকার ভাবছে। মানসিক চাপ কমাতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিশুদের পরীক্ষা বাতিলের চিন্তা করছে সরকার। যদিও গ্রামাঞ্চলে কিন্ডারগার্টেনে (কেজি) শিশুদের ভর্তির সুযোগ নেই। বাবা মায়ের ভিতরে কাজ করে শিশুদেরকে শক্ত প্রতিযোগি হিসেবে গড়ে তোলতে না পারলে বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতামূলক চাকুরীর বাজারে সে ঠিকে থাকতে পারবে না। সবারই উদ্দেশ্য সন্তান যাতে জীবনের প্রতিটি একাডেমিক সকল পরীক্ষাতেই এ প্লাস পায়। নৈতিক শিক্ষায় কত পেলো সেটা আমরা অনেকেই দেখি না। শুধু এ প্লাস পেতেই হবে শিশুদের মাথায় সেটাই সেট করে দিয়ে থাকি। শিশু কতটুকু শিখলো সেটা বড় কথা নয় তার খাতায় যদি একশ নম্বরের মধ্যে নিরানব্বই থাকে সেটাতেই আমার খুশি থাকি। নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা কতটুকু অর্জন করলো সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। শিশুদের সাথে সাথে অভিভাবকও শিক্ষার এ দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এর প্রমাণ প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল। যে দিন ফলাফল প্রকাশিত হয় সেদিন অভিভাবকদের সেকি উচ্ছাস। আর যেসব সন্তান এ প্লাস পায় নাই তাদের বাবা মায়ের সে কি করুণ আকুতি। যেন প্রিয়জন হারানোর চেয়ে এ বেদনার ভার বেশি। এক সময় দেশে এমন অবস্থা ছিলো না। বাবা মা চাইতেন লেখাপড়া শিখে সন্তান মানবিক মানুষ হোক। লেখাপড়া শিখে একজন মানবিক মানুষ হলে তার মধ্যে দেশপ্রেম থাকবে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকবে। আর যদি সে প্রকৃত মানুষ না হয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে একটি ওজনধারী সনদ গ্রহন করেও সেটা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন কাজে আসবে না। যার বর্তমান প্রমাণ আমরা এখন পাচ্ছি। দেশে হাজার কোটি টাকার দূর্নীতির সাথে জড়িত তথাকথিত ওজনধারী উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা। জাতীয় পত্রিকায় হেড লাইন আসে সাগর চুরির কথা। আমরা আগে শুনতাম পুকুর চুরি। এখন নতুন সংযোজন সাগর চুরি। এতেই প্রমাণিত হয় দূনীর্তি লাগাম ছাড়া। দেশে এই অবক্ষয়ের কারণ প্রকৃত নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার অভাব। বর্তমান অর্থ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় চাকুরীর উদ্দেশ্য থাকে দ্রুততম সময়ে অধিক অর্থ উপার্জন করা। সেটা বৈধ বা অবৈধ হোক। এসব সামাজিক বৈষম্য দেখেই অসুস্থ পরিবেশে আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠছে। তখন তাদের মনের মধ্যেও এই ভাবনা কাজ করে পড়াশুনা শেষ করে আমি প্রচুর টাকা রোজগার করব। ফ্লাট কিনব। দামী গাড়ি কিনব। সেটা বৈধ আয়ে হলে কারো আপত্তি থাকে না। কিন্তু অবৈধ হলে সেটাতেই সবার প্রশ্ন থাকে। অনেকের চাকুরীতে আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য নাই। কিন্তু সেই লোকটি বিত্তশালী হিসেবে সমাজে বিচরন করছেন্ । এটাতে তিনি সমাজে একটি ভুল বার্তা দিচ্ছেন। সেটা হলো লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হলো প্রচুর বিত্ত অর্জন। লেখাপড়া শিখে সন্তান একটি চাকুরী করবে সেটাই ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বাভাবিক চিত্র। এই যে শিক্ষা জীবনে বাবা মা সহ শিক্ষার্থীদের এই তীব্র প্রতিযোগিতা। এর পেছনে নিশ্চয় কারণ রয়েছে। সেটা হলো শিক্ষা জীবন শেষ করে একটি ভালো মানের চাকুরী। আমরা যখন প্রাথমিকে, মাধ্যমিকে পড়ি যখন বুঝতাম পড়াশুনা শেষ করে একটি চাকুরী করব। সেটা যে কোন চাকুরীই হোক। সরকারি চাকুরীর চাহিদা বেশ সেটা বুঝতাম। ক্লাসের সেরা মেধাবী ছাত্রটি চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হবেন সেটাও প্রায় অনেকটা নিশ্চিত। আর এর পরের সারির শিক্ষার্থীরা অন্য পেশায় যাবেন। অনেক দিন ধরেই সেটা চলে আসছে। দিন পরিবর্তন হয়েছে। এখন চাকুরীতে পেশাগত বৈষম্য ও সুযোগ সুবিধার অভাবে দেশের মেধাবী সন্তানেরা তাদের পেশাগত কাজে মনযোগ দিতে পারছেন না। সবাই চায় যে পদে ক্ষমতা ও অর্থ বেশি সেই চাকুরী। তাই এখন পেশা নির্বাচন খুবই কঠিন। এখন পেশা বলতে যে পেশায় অর্থ বেশি পেশাটাই সবাই চায়। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর একটি হলো একই পদে দশ পনের বছর চাকুরী করে কোন পদোন্নতি পাচ্ছেন না। ফলে তাদের মনের মধ্যে একটি অসন্তোষ বিরাজ করে। ক্যাডার সার্ভিসেও সেটা পরিলক্ষিত হয়। দু তিনটি ক্যাডার পদ ছাড়া নিয়মিত পদোন্নতি না থাকায় ক্যাডার বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আমাদের সন্তানেরা বর্তমানে লেখাপড়া শেষ করে দেশের সকল সুযোগ সুবিধা সম্বলিত দু তিনটি চাকুরীর পেছনে ছুটছেন। কাংঙ্খিত চাকুরীটি না পেলে লক্ষ লক্ষ মেধাবী তরুণ তরুণীরা হতাশ হয়ে পড়েন। তার কারণ যে চাকুরটি তিনি করছেন সেখানে সামাজিক মর্যাদা ও নিয়মিত পদোন্নতি নিয়ে তিনি শংকিত। আর চাকুরীতে নিয়মিত পদোন্নতি না পেলে সামাজিক মর্যাদা থাকে না বলেই হতাশা বাড়ে। কাজের স্পৃহা থাকে না। তাই এসব কারণেই প্রতি বছর দেশের হাজার হাজার মেধাবী তরুণ তরুণী হতাশা নিয়ে দেশ ছাড়ছেন। যা দেশের জন্যে বিরাট এক ক্ষতি। আমরা ছেলেবেলায় বাংলা বা ইংরেজিতে রচনা লিখতে গিয়ে ডাক্তার হবার স্বপ্নের কথা লিখতাম। কারণ ডাক্তরা সমাজে র্মযাদার আসনে আসীন ছিলেন। আজও শিশুরা লিখে কিনা জানি না। বর্তমানে দেশের চিকিৎসরাও কর্মক্ষেত্রে যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তদ্রুপ প্রকৌশলীদের ক্ষেত্রেও। দেশে যদি সকল সরকারি বেসরকারি চাকুরীতে মেধা ও কাজের দক্ষতার ভিত্তিতে সঠিক সময়ে পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হতো তাহলে পড়াশুনা শেষ করে কে কোন পেশায় কাজ করছেন সেটা নিয়ে চিন্তা থাকতো না। আর পেশা নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করতে হাতো না। পড়াশুনা শেষ করে যে কোন পেশায় কাজ করতে সাচ্ছন্ধ বোধ করতে পারেতেন। আর এখনকার তরুণ তরুণীদের কাংঙ্খিত দুই তিনটি চাকুরীর মোহ ত্যাগ করতে পারছেন না। আর যদি সেটা পেয়ে যান তাহলে তিনিই হয়ে যান সফলতার প্রতীক। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, পড়ায় পাড়ায়, গল্প চলতে থাকে। সেটা দোষের কিছু না। কিন্তু তার সাথের বন্ধু বান্ধবেরা কাংঙ্খিত স্থানে পৌছতে না পারায় হীনমন্নতায় ভোগেন। অন্য চাকুরীতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করতে থাকেন। আমাদের এই সংস্কৃতি সুখের নয়। দেশের সকল মেধাবী সন্তানেরা যে পেশায় চাকুরী করুক না কেন সে পেশাতেই যদি মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা সমান থাকে তাহলে তিনি সাচ্ছন্ধে দেশকে সেবা দিতে পারবেন। আর সেটা পান না বলেই তাদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসে। আমরা কেহই পৃথিবীতে চির দিন থাকব না। আমাদের উচিত নতুন প্রজন্মের জন্যে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্তা গড়ে তোলা। আর সেটার লক্ষ্যেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের ডাক দিয়েছিলেন। দেশ স্বধীন হয়েছে তবে সমাজে, রাষ্ট্রে বৈষম্য এখনও শেষ হয় নাই। এটা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। আমাদের সন্তানেরা পড়াশুনা শেষ করে মানবিক মানুষ হোক । দেশপ্রেমে ও মানবিকতাবোধ হৃদয়ে ধারন করে দেশ সেবায় নিয়োজিত হোক। আর সেটাই হোক সবার লক্ষ্য। সরকারি বেসরকারি সকল চাকুরীতে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা নিশ্চিত হোক। কোন পেশাই খাটো নয় সমাজের সকল পেশার মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকুক। এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রভাষক, সরকারি দিগেন্দ্র বর্মন কলেজ, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ।