বিশেষ প্রতিনিধি::
হাওরে স্থায়ী কর্মসংস্থান না থাকায় উন্নত জীবনের স্বপ্নে হাওর ছেড়েছিলেন শাল্লা উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের দিনমজুর সৌরভ দাস। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কয়েক বছর আগে ঢাকা চলে গিয়েছিলেন তিনি। একটি বস্তিসম এককক্ষের বাসা ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই পোষাকশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর সুযোগ ছিলনা। এবার মহামারি করোনা বাধ্য হয়ে তাদেরকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে। বৈশাখে এসে হাওরের ধান কেটে প্রায় ৬ মাসের খোরাকি সংগ্রহ করেছেন। এখন ভরা বর্ষায় হাওরে মাছ ধরছেন। তবে ইজারাদারের হয়ে প্রশাসন তাদের মাছ ধরায় বাগড়া দেওয়ায় জাল-নৌকা হারাতে হচ্ছে তাদের। দেশিয় সনাতন পদ্দতিতেও তাদের মাছ ধরতে দেওয়া হচ্ছেনা। হাওরের সীমানা চিহ্নিত করে মাছ ধরার সুযোগ দিলে তিনি হাওরে অনায়াসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন বলে জানালেন।
শুধু সৌরভ দাসই নয় একই উপজেলার সুখলাইন গ্রামের সুষেন দাস, ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নে নুরপুর গ্রামের ঝুমন মোড়ল, বাবুপুর গ্রামের আব্দুর রব ও একই গ্রামের এনামুল হকের। দিনমজুর এই মানুষজন হাওরে কর্মহীন হয়ে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে সপরিবারে গার্মেন্টে কাজ শুরু করেছিলেন। মহামারি করোনা ঢাকা থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকায় খেয়ে না খেয়ে কিছুদিন থেকে তারা আবার নীড়ে ফিরে আসেন। এসে অপার হাওরের কাছেই ঠাঁই নিয়েছেন। এই হাওরে গত বৈশাখে ধান কেটে খোরাকি সংগ্রহ করেছেন। এখন মাছ ধরছেন। তিনবেলা হাওরের সুস্বাদু তাজা মাছ খাচ্ছেন। তবে উন্মুক্তভাবে মাছ ধরার সুযোগ দিলে তারা কখনো হাওর ছেড়ে যাবেন না বলে জানিয়েছেন। এতে তাদের সন্তানদেরও পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি হবে। হাওর ছেড়ে বাইরে গেলে অনিশ্চিত জীবনের পাশাপাশি সন্তানদের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান তারা।
হাওর আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, সুনামগঞ্জে কর্মসংস্থানের স্থায়ী কোন সুযোগ নেই। বৈশাখে মওসুমী ধান কাটা আর বর্ষায় মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোন সুযোগ নেই। হাওরের শ্রমিকদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে আশির দশকে ‘জাল যার, জলা তার’ স্লোগানে ভাসান পানিতে মাছ ধরার আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কমরেড বরুণ রায়। হাওরাঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এই আন্দোলন। ভাসান পানিতে মাছ ধরার পক্ষে বিশাল জনমত তৈরি হয়। সভা-সমাবেশ হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলে ভয় পেয়ে যায় ইজারাদাররা। তাই তারা তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার-জুলুম করে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্যাতন করে। এতেও দমানো যায়নি। জানা গেছে শেষে ইজারাদার ও প্রশাসন আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে আন্দোলনটি স্থিমিত করে দেয়। আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই সময় ভাসান পানির সীমানা চিহ্নিত করে হাওরের অসহায় মানুষদের মাছ ধরার সুযোগ তৈরি করে দিলে হাওর ছাড়াতোনা গরিব মানুষেরা। তারা স্থায়ীভাবে হাওরে থেকে মাছ ধরার পাশাপাশি মওসুমে ধান কাটায় শ্রমিক হিসেবে যুক্ত হতে পারতো। এতে পাহাড়ি ঢল ও শিলায় ফসলহানিও ঠেকানো যেতো। কারণ প্রতি বছরই হাওরের ফসল শ্রমিকের অভাবে পাহাড়ি ঢল ও শিলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় নিবন্ধিত ৯৩ হাজার মৎস্যজীবী রয়েছে। এর বাইরে আরো ৩০ হাজার ৭৪৩ জন ভাসমান মৎস্যজীবী রয়েছে। তবে বর্ষায় পেশা হিসেবে মৎস্যজীবী নয় এমন অনেক গৃহস্তই মাছ ধরেন। এ সময় হাতে কাজ না থাকায় বাড়ির পাশের থৈ থৈ পানিতে আবহমান কাল থেকেই মাছ ধরছেন। কিন্তু ইজারাদার ও প্রশাসনের অভিযানে এসময় অসহায় মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে পারেননা। বরং ভাসান পানিতে মাছ ধরার অভিযোগে এমনকি দেশিয় পদ্দতিতে (গুই) দিয়ে মাছ ধরার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের সরঞ্জাম পুড়ানো হয়। এতে তারা নিঃস্ব থেকে আরো নিঃস্ব হয়। যার ফলে উপায় না দেখে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তাছাড়া ইজারাদাররা মৎস্য আহরণের মওসুমে জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরলেও প্রশাসন কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেনা। আইন বহির্ভূতভাবে জলাশয় শুকিয়ে মাছ আহরণ করায় হাওরের অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
সৌরভ দাস বলেন, করোনার কারণে ঢাকায় অবরুদ্ধ ছিলাম। যা অল্প সঞ্চয় ছিল তাও শেষ হয়ে যায়। একদিন রাতের আধারে ট্রাকে করে পথ ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাড়ি ফিরে আসি। এসে সারা মাস হাওরে ধান কেটেছি। এতে প্রায় ৬ মাসের খাবার সংগ্রহ হয়েছে। এখন হাওরে মাছ ধরছি। কিন্তু প্রশাসন ভাসান পানিতেও মাছ ধরতে বাধা দিচ্ছে। নৌকা-জাল পুড়িয়ে দিচ্ছে।
ধর্মপাশার বাবুপুর গ্রামের আব্দুর রব বলেন, কাম না পাইয়া ঢাকা গেছলাম। গার্মেন্সে গিয়া কাজ খুজে নেই। তবে বাচ্চা-কাচ্চাকে পড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, হাওরে কাজ পেলে কখনো হাওর ছেড়ে যাবনা। ভাসান পানিতে মাছ ধরার সুযোগ দিলে আমার মতো হাওরের কোন গরিব এলাকা ছাড়বেনা।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি প্রফেসর চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, আমরা আশির দশকে ‘জাল যার, জলা তার’ স্লোগানে ‘ভাসান পানি আন্দোলন’র মাধ্যমে হাওরে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলাম। এই দাবিতে উত্তাল ছিল হাওরবাসী। সাময়িক এই আন্দোলন ইজারাদার ও ক্ষমতাসীনদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। তাই তারা জুলুম নির্যাতন করেছিল আমাদের। এই আন্দোলনটি সফল হলে হাওরের অসহায় মানুষ কখনো হাওর ছেড়ে যেতোনা। অনিশ্চিত হয়ে পড়তোনা হাওরের কৃষি অর্থনীতি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, হাওরে নিবন্ধিত মৎস্যজীবী ছাড়াও হাওরের কৃষকরাও বর্ষায় মাছ ধরেন। তবে যারা পোনা মাছ নিধন করেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান চালাই। তিনি বলেন, হাওরের সীমানা চিহ্নিত করার এখতিয়ার জেলা প্রশাসনের। এটা হলে স্থায়ী একটা কাজ হতো। তবে হাওরাঞ্চলের ইজারাদাররা মওসুমে জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরে এই অভিযোগ আমরা পাই।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আমি বারবারই বলি হাওরের জলাশয় ইজারা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইজারাদাররা হাওরের পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র ধ্বংস করছে। এরচেয়ে উন্মুক্তভাবে মাছ ধরার সুযোগ পেলে হাওরের গরিব মানুষ বেশি উপকৃত হতো।