বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের শাল্লায় যোদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামি জোবায়ের মনির অসুস্থতা দেখিয়ে আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় এসে নৌবিহার করেছে। মামলার বাদী ও সাক্ষীদের বাড়ির সামনে এসে বাহিনী নিয়ে আনন্দ ফূর্তির পাশাপাশি হুমকি ধমকিও দিয়ে গেছে। এ ঘটনায় মামলার বাদি, সাক্ষী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন আতঙ্কে আছেন। এই এলাকায় আর্ত-সামাজিকভাবে একক প্রভাবশালী হিসেবে এখনো প্রতিষ্ঠিত জোবায়ের মনিরের পরিবার। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন সবসময়ই তটস্থ থাকেন।
যোদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ২০১৬ সনে ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগে জোবায়ের মনির, তার ভাই প্রদীপ মনির ও চাচা মুকিত মনিরসহ যোদ্ধাপরাধে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ দায়ের হয়। ওই বছরের ২১ মার্চ অভিযোগের তদন্তকাজ শুরু করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পেরুয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রজনী দাসের দায়েরকৃত মামলায় ২০১৮ সনের ২০ ডিসেম্বর জোবায়ের মনির, জাকির হোসেন, তোতা মিয়া টেইলার, সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুল জলিল, আব্দুর রশিদসহ অভিযুক্ত ৬ যোদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযোগ দায়েরের পরই আমেরিকায় পালিয়ে যায় অভিযুক্ত যোদ্ধাপরাধী জুনেদ মনির, যোদ্ধাপরাধী মামলায় দ-প্রাপ্ত কামরুজ্জামানের আইনজীবী ও ইসলামি ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি শিশির মনিরের বাবা যোদ্ধাপরাধী মুকিত মনির। ২০১৯ সালের ১৭ জুন তদন্ত সংস্থা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জোবায়ের মনিরসহ ১১জন জড়িত বলে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করে। এদিকে গ্রেপ্তারের পরেই জোবায়ের মনির নানা ছুতোয় জামিনের চেষ্টা করে। অবশেষে গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতকে অসুস্থতার সাজানো তথ্য দিয়ে জোবায়ের মনির ‘টাওন জামিন’ মঞ্জুর করিয়ে নেয়। শর্তমতে শহরে বাসায় অবস্থানের নির্দেশনা দিয়ে জামিন মঞ্জুর করা হলেও সুস্থ জোবায়ের মনির প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এলাকায়ও। এবার ঈদুল আজহার আগে শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে এসে ঈদের জামাত আদায়সহ একাধিক পশু কোরবানি দিয়েছে। তাছাড়া ঈদের পরদিন স্পিডবোট ও নৌকা নিয়ে নৌবিহার করে আনন্দ ফূর্তি করেছে। তার নৌবিহারের নৌকাটি যোদ্ধাপরাধ মামলার স্বাক্ষীদের বাড়ির কাছে এসে পরোক্ষভাবে হুমকি ধমকি দিয়ে গেছে। অনেককে প্রলোভন দেখিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে গৃহজামিন নিয়ে বাইরে এসে নৌবিহার, আনন্দভ্রমণ এবং মামলার স্বাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখানোর খবর পেয়ে আন্তর্জাতিক যোদ্ধাপরাধ ট্রাইনব্যুনালের সংশ্লিষ্টরা সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবগত করেছে। সংস্থার পক্ষ থেকে শাল্লা থানা ও দিরাই থানার ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে লিখিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
শাল্লা থানার ওসি সনজুর মোরশেদ বলেন, আমরা শুনেছি যোদ্ধাপরাধী মামলায় গৃহজামিনে থাকা আসামি জোবায়ের মনির ঈদে বাড়িতে এসেছেন। তবে নৌবিহার করেছেন কি না আমরা জানিনা। আমরা এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করব।
আন্তর্জাতিক অরাধ ট্রাইব্যুনালের এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নূর হোসেন বলেন, যোদ্ধাপরাধী হিসেবে জোবায়ের মনিরসহ ১১ জনের অপরাধের অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছি আমরা। এর মধ্যে ৬জন গ্রেপ্তার হয়েছে। জোবায়ের মনির অসুস্থতার কথা বলে আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় এসে নৌবিহার করেছে বলে জানতে পেরেছি। আমরা এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার ও দিরাই থানার ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। লিখিতভাঊের আমরা এ বিষয়ে জানার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা খবর পেয়েছি জোবায়ের মনির তার বাহিনী নিয়ে মামলার স্বাক্ষীদের ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়েছে।
সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক যোদ্ধাপরাধ তদন্ত সংস্থা থেকে এ সংক্রান্ত মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। আমি সংশ্লিষ্টদের দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।
উল্লেখ্য ১৯৭১ সনের ৪ ডিসেম্বর হাওরাঞ্চলের শীর্ষ দালাল আব্দুল খালেকের নির্দেশে পেরুয়া, উজানগাও, শ্যামারচরে ভয়াবহ গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ যোদ্ধাপরাধ সংগঠিত হয়। শ্যামারচর বাজারের স্কুলের সামনে ২৭ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে লাইন ধরিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। পরে কয়েকটি পল্লিতে প্রায় ৩ শতাধিক প্রশিক্ষিত রাজাকার বাহিনী দিয়ে নারীদের ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। এই গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয় দালাল আব্দুল খালেকের ভাই মুকিত মনির, কদর আলী, ছেলে প্রদীপ মনির জুনেদ, জোবায়ের মনিরসহ প্রশিক্ষিত রাজাকার বাহিনী। ১৯৭২ সনে যোদ্ধাপরাধী কদর আলীকে দালাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই এলাকায় আর্ত-সামাজিকভাবে জোবায়ের মনিরের পরিবার প্রতিষ্ঠিত থাকায় এখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন কোণঠাসা। মুক্তিযুদ্ধের পর গণহত্যার চিহ্ন মুছে ফেলেছিল তারা। ২০১৩ সনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চের আগে এই এলাকায় তাদের হুমকি-ধমকিতে গণহত্যা দিবস কখনো পালন করা সম্ভব হয়নি।