আলফ্রেড সরেনকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার একমাত্র সন্তান ঝর্ণা সরেনের বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর। আজকের বিবাহিত ও সংসারী ঝর্ণা সরেনের কাছে তার বাবার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। মাসী মরিয়ম হাঁসদা ঝর্ণাকে দেখাশোনা করেন। আলফ্রেড হত্যার পর ভূমি দখলদারদের কারণে আলফ্রেডের পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। তারপর রাজশাহীর তানোরের মথুরাপুর থেকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবির মহিপুর, ঢাকার এক ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে আবার রাজশাহীর মথুরাপুর। বছর বছর বেঁচে থাকার সংগ্রামে বিশ বছরের এক যাযাবর জীবন। বিশ বছরেও আলফ্রেড সরেন হত্যার ন্যায়বিচার পায়নি তার পরিবার। কিন্তু দেশে আদিবাসী ভূমি আন্দোলন সংগ্রামের এক জীবন্ত স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছেন আলফ্রেড। এই দীর্ঘ বিশ বছরে আলফ্রেডের মৃত্যুদিবসে আদিবাসী জনসংগঠন নানাভাবে সোচ্চার হয়েছে, আদিবাসী ভূমি দখলের অনিবার্য গণিতকে প্রশ্ন করেছে। নাট্যদল আরণ্যক এই ঘটনাকে উপজীব্য করে মঞ্চস্থ করে চলেছে নাটক ‘রাঢ়াং’। কিন্তু নিদারণভাবে আলফ্রেডের গ্রাম থেকে দিনে দিনে আদিবাসীরা উদ্বাস্তু হয়েছেন। মেলেনি বিচার, সুরক্ষিত হয়নি ভূমির অধিকার। আজ বিশ বছর পরে বৈশ্বিক এই করোনা মহামারীকালে আলফ্রেড হত্যা এবং আদিবাসী ভূমিপ্রশ্নকে আবারো আলাপে টানার এক বিশেষ কারণ আছে। দুনিয়াজুড়ে আলাপ ওঠেছে করোনা সংকটের পর বদলে যাবে পৃথিবী। শুরু হবে এক ‘নিউ নরমাল’ বা নয়া স্বাভাবিকতা। বিশ্বাস করতে চাই, করোনা-উত্তর ‘নয়া-স্বাভাবিকতার’ দিনে করোনা-পূর্ব বঞ্চনা আর বৈষম্যের অবসান হবে। আলফ্রেড হত্যার বিচার হবে আর ভূমির ন্যায্য হিস্যা ফেরত পাবে বঞ্চিত আদিবাসীরা।
রক্তাক্ত ১৮ আগস্ট ২০০০
আলফ্রেডের জন্ম নওগাঁর মহাদেপুরের ভীমপুর গ্রামের এক সাঁওতাল কৃষক পরিবারে। মা ঠাকুররানী হাঁসদা এবং পিতা গায়না সরেন । ভীমপুরের প্রায় ৪৬০ বিঘা জমি নিয়ে সাঁওতাল ও প্রভাবশালী কিছু বাঙালিদের ভেতর এক ভূমি-বিবাদ তৈরী হয়। সাঁওতালেরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে এইসব জমিতে আবাদ ও বসবাস করে আসছিলেন। এলাকার প্রাক্তন চেয়ারম্যান হাতেম আলী সাঁওতালদের উচ্ছেদের জন্য এক ষড়যন্ত্র করে এবং নানা সময়ে হুমকিধামকি দেয়া শুরু করে। এই চক্রান্তে যুক্ত হন ভূমির উত্তরাধিকারদের একজন সীতেশ ভট্টাচার্য (গদাই লস্কর নামে পরিচিত)। তাদের মূল লক্ষ্য সাঁওতালদের ৪৬০ বিঘা আবাদী শস্যফলা জমিন। ভূমি সুরক্ষায় সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনে নামেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ভীমপুর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি আলফ্রেড সরেন। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টার্চাদের ভাড়াটে দল সশস্ত্র আক্রমন করে ভীমপুর সাঁওতাল গ্রামে। বাঙালিদের উচ্ছেদ আক্রমন ঠেকাতে আলফ্রেডের নেতৃত্বে জোৎস্না সরেন, রেবেকা সরেন, বিশ্বনাথ বেসরা, সুবল বেসরা, কমল সরেন, দেবেন সরেন, অনিল সরেন ও শ্রীমন্ত হেমব্রমরা গ্রামবাসীদের নিয়ে রুখে দাঁড়ান। আক্রমনকারীদের আঘাতে ৩২ বছর বয়সে নিহত হন আলফ্রেড সরেন। আহত ও জখমপ্রাপ্তরা দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেন।
কী ঘটেছিল এক সপ্তাহ আগে?
২০০০ সনের ১৮ আগস্ট খুন হন আলফ্রেড। কিন্তু কী ঘটেছিল এর সাত দিন আগে? ২০০০ সনের ১১ আগস্ট দুপুরবেলা হাতেম আলীর নেতৃত্বে সীতেশ ভট্টাচার্যের ভাড়াটে বাহিনি ভীমপুর গ্রামে ঢুকে এলোপাথারি হামলা চালায়। মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হন বিশ্বনাথ বেসরা, আলফ্রেড সরেন, সুবল বেসরা ও শ্রীমন্ত হেমব্রম। সবাই মহাদেবপুর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। বিশ্বনাথ বেসরাকে ভর্তি করাতে হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর জানতে পারেন আলফ্রেড খুন হয়েছে।
কী ঘটেছিল ১৯৮৭ সনে?
পিযূষ ভট্টাচার্য ও সীতেশ ভট্টাচার্য নওগাঁর এক ধনী পরিবার। তাদের মামাদের ফেলে যাওয়া অনেক জমিজমা একটা সময় ‘২নং খাস খতিয়ান’ হয়ে যায়! এইসব জমি নিজেদের দখলে রাখার নিমিত্তে তারা ভূমিহীন আদিবাসীদের ব্যবহার করেন। রাজশাহীর তানোরের মোহর গ্রামে থাকতেন গায়না সরেন, আলফ্রেডের বাবা। আদিবাসীদের বলা হয় ভীমপুরে গিয়ে চাষাবাদ করলে প্রতি পরিবারকে পাঁচ বিঘা করে জমি রেজিষ্ট্রি করে দেয়া হবে। ভীমপুরে এসে ১৩ সাঁওতাল পরিবার শুরু করে চাষাবাদের এক কঠিন সংগ্রাম। পীযূষ ভট্টাচার্যদের কাছ থেকে পায় ১২০ বিঘা বরেন্দ্রভূমি। ২০০০ সনের ১৮ আগস্টের আগেই মারা যান পীযূষ ভট্টাচার্য। তার ভাই সীতেশ ভট্টাচার্য এবং হাতেম আলীরা সাঁওতালদের নামে বন্দোবস্ত করে দেয়া এই জমিন জবরদখলের এক নিদারুণ ষড়যন্ত্র করে যা ভাংচুর-হামলা-খুন-জখম পর্যন্ত গড়ায়। হাতেম আলী বিরুদ্ধে এলাকার হিন্দুদের আরো ৩২ বিঘা ও বলিহারে আদিবাসীদের ৭ বিঘা জমি জবরদখলের অভিযোগ আছে।
মামলা হয়েছিল, কিছু দিন পুলিশ পাহারাও ছিল
আলফ্রেড হত্যার পর ভীমপুরে প্রায় সাড়ে তিন বছর একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ছিল। আলফ্রেডের বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতারও করে। নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। মামলার প্রধান দুই আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্যসহ ৬০ জন জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ করে। আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। মামলাটি এখন হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আসামীরা এখনো হুমকী-ধামকি থামায়নি। ২০০৩ সনে প্রায় সব আদিবাসীরাই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ২০১৫ সনের ২৩ ডিসেম্বর আসামীরা আবারো আলফ্রেডের বড় ভাই ও তার স্ত্রীর উপর হামলা করে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নওগাঁ জেলা ও দায়রা আদালত ১২০ বিঘা জমির ভেতর ৬৩ বিঘা জমি আলফ্রেড সরেনসহ আদিবাসীদের অনুকূলে বন্দোবস্তী দেয়। কিন্তু সেই ৬৩ বিঘা জমির ভেতর ৩৩ বিঘাই আসামীরা জবরদখল করে রেখেছে। আদিবাসীরা মাত্র সাড়ে বত্রিশ বিঘা জমি কোনোমতে চাষাবাদ করতে পারছেন।
করুণ নিরুদ্দেশ
সারাদেশে জনসংখ্যা বাড়ে। কিন্তু ভীমপুর সাঁওতাল গ্রামে দিনে দিনে সাঁওতালদের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে কমতে থাকে। আলফ্রেড হত্যার আগ পর্যন্ত গ্রামে ১৬ পরিবার সাঁওতাল ছিল। এখন আছেন আট পরিবার। সুবল বেসরা, কমল সরেন, দেবেন সরেন, কমল সরেন, অনিল সরেন ও শ্রীমন্ত হেমব্রমের পরিবার গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। বর্তমানে ৮ পরিবার সাঁওতালসহ ৫ পরিবার বর্মণ, মালো ও বৈরাগী ১ পরিবার নিয়ে ১৬ পরিবার আদিবাসী আছেন ভীমপুর গ্রামে। অপেক্ষা করছেন ভূমি যন্ত্রণার দু:সহকাল কাটবে। বিচার হবে আলফ্রেড হত্যার।
করোনা-উত্তর ‘নিউ নরমাল’ ও আদিবাসী ভূমিপ্রশ্ন
তেভাগা আন্দোলনের সময় কবিয়াল রমেশ শীলের একটি গান জমিদারি বলপ্রয়োগের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ‘বাংলার কৃষক ভাইগণ, হওরে চেতন/ জমিদারের হাতের মুঠায় কৃষকের জীবন। মাথার ঘাম পায়েতে ফেলি জলে ভিজি রোদে জ্বলি/ আট মাস থাকে গোলা খালি, নিত্য অনটন/ বন্যায় মারে, পোকায় কাটে, জমিদারে ভাগা লুটে/ রেহাই চাইলে জ্বলি উঠে, আগুনের মতন/ শোষণকারী জমিদার, জমিদার নয় ‘যম-দুয়ার’/ লাঙল যার জমি তার, কৃষকের এই পণ/ হিন্দু-মুসলমানে মিলি, একসাথে আওয়াজ তুলি/ জমিদারী যাক চলি, বাঁচিবে জীবন। লর্ড কর্ণওয়ালিশের সময় ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়নের ভেতর দিয়ে জনগণের জমির একক মালিক হয়ে ওঠে রাষ্ট্র। ভূমির সাথে জনগণের গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত যৌথ মালিকানা বদলে গিয়ে জমি পরিনত হয় ব্যাক্তিগত বাণিজ্যিক পণ্যে। তৈরী করা হয় জমির পর্চা, দাখিলা, পত্তনরশীদ, দলিল এবং টাকা দিয়ে ভূমি কেনাবেচার এক প্রশ্নহীন প্রক্রিয়া। ভূমি আইন ও খাজনা প্রথায় নিপীড়িত কৃষকসমাজ সংগঠিত করেন ঐতিহাসিক আন্দোলন। টংক, নানকার, তেভাগা, ভানুবিল আন্দোলনসহ সবগুলো শ্রেণীলড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের মেহনতি আদিবাসী সমাজ। হাজং, কোচ, বিষ্ণুপ্রিয়া ও মীতৈ মণিপুরী, সাঁওতাল, ওরাঁও, মুন্ডা কী নি¤œবর্গের বাঙালি জনগণ। জমিদারি আমল কী ব্রিটিশ উপনিবেশ চলে গেলেও এখনও ভূমির উপর নিশ্চিত হয়নি আদিবাসী জনগণের অধিকার। এখন আমাদের চাষাবাদের জমিনের প্রায়টাই ভিন্ন কায়দায় দখল করে রাখছে বহুজাতিক কোম্পানি। যারা জমির বুক ও কলিজা থ্যাৎলে দিয়ে রাসায়নিক সার-বিষ-হাইব্রিড কী সংহারী বীজের ব্যবসা করে। ভূমির বুক ছিন্নভিন্ন করতে সমকালে আরও যুক্ত হয়েছে বনবিভাগ, অধিগ্রহণ, অবকাঠামো নির্মাণ, নগরায়ণ। জমি জমার প্রতিবেশীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক অধিকার চাইতে গিয়ে তেভাগা আন্দোলনে শহীদ হন শিবরাম মাঝি ও কম্পরাম সিং। টংক আন্দোলনে রাশিমনি হাজং, সুসং দূর্গাপুরে সত্যবান হাজং, জুড়িতে অবিনাশ মুড়া, মধুপুরে গীদিতা রেমা বা পীরেন স্নাল। একই ধারাবাহিকতায় নওগাঁর ভীমপুরে আলফ্রেড সরেন। এরা সকলেই ভূমির ঐতিহাসিক উত্তারাধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রের অনিবার্য ভূমি দখলের গণিতকে বুকের রক্ত ঢেলে প্রশ্ন করে দাঁড়িয়েছিলেন। করোনা-উত্তর ‘নিউ নরমাল’ সময়ে রাষ্ট্রের কান ও কলিজা কী সেই আওয়াজ শুনতে প্রস্তুতি নিবে?
…………………………………………………………
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: animistbangla@gmail.com