গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৭ মার্চ থেকে সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে । করোনা মহামারী দীর্ঘায়িত হওয়ায় আপাতত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় চালু রাখতে ও শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার চালু করে অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম । মাধ্যমিকে ২৯ মার্চ থেকে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ আর প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য ৭ এপ্রিল থেকে চালু হয় ‘ঘরে বসে শিখি’ শিরোনাম টেলিভিশনে বিকল্প পাঠদান। অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম দেখার জন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়।
নানা অসুবিধা থাকা সত্বেও অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম সচল রাখতে ব্যাপক ভুমিকা পালন করেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা। তারই ধারাবাহিকতায় ইউটিউবে, ক্যাবল স্যাটেলাইটে, ফেইসবুকে ও অন্যান্য মাধ্যমে চলে অনলাইন ক্লাস। অনেক শিক্ষকের স্মার্টফোন নেই, এমনকি অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে কিনতে হলো স্মার্টফোন। শিক্ষকরা স্কুলে থেকে, ঘর থেকে, বাহিরে থেকে, ঘরের দেয়ালে, আঙ্গিনায় বোর্ড লাগিয়ে ল্যাপটপে, স্মার্টফোনটি বাঁশে বা খুঁটিতে বেঁধে ‘ক্যামেরা ভয় ভীতি’ উপেক্ষা করে প্রদর্শন করেন ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট, ২০ মিনিট, ৩০ মিনিট, ৪০ মিনিটের ক্লাস।
সব শিক্ষকরাও এমনিই প্রযুক্তিতে ততটা দক্ষ নন। নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেই অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে নিতে হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে অবস্থান করছেন। গ্রামে নেটওয়ার্কের চরম সংকট তার উপরে সিম কোম্পানিগুলোর ডাটা প্যাক সহজলভ্য নয়। করোনাকালে আয়ের উৎস বন্ধ থাকায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা দায়। সেখানে অনলাইন ক্লাসের জন্য বাড়তি খরচ করাও যাচ্ছে না। অনেকের নেই প্রয়োজনীয় ডিভাইস। তারপরও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন শিক্ষকরা।
অনলাইন ক্লাসের সুবিধাটা সব শিক্ষার্থীরা নিতে পারছেন না। শহরে অবস্থানরত বা যাদের সামর্থ্য সুযোগ সুবিধা আছে সেই সব শিক্ষার্থীরা ছাড়া। “অপরদিকে গ্রামে অবস্থান করা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছেন অনলাইন ক্লাসের সুবিধা থেকে”। হাওর ও দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত। অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত অনেক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। নানা কারণে অবহেলিত শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস না করতে পারলেও, পরবর্তীতে ফেসবুকে এসে তারা ঠিকই প্রকাশ করছে তাদের মনোবেদনা। কিংবা অনেকে হয়তো এটুকু দুঃখ প্রকাশেরও সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে এ ব্যাপারে আর সন্দেহের অবকাশই থাকছে না যে, অনলাইন ক্লাস স্পষ্ট হয়েছে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন এক বৈষম্য ও বিভাজনের দেয়াল গড়ে তুলেছে।
ইউটিউব, ফেইসবুক অন্যান্য মাধ্যমে শিক্ষকরা লেকচারগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌছে দেওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষকরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাতেও দায় সাড়াভাব লক্ষ করা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ উপকৃত হবে বলে মনে হয় না। তারা সুন্দর, সাবলীল, বোধগম্য ও আকর্ষণীয় লেকচার দিতে পারছেন না। এমনকি তারা যে ক্যামেরা ব্যবহার করছে সেটিও স্পষ্ট নয়, লেখাগুলো দেখা যাচ্ছেনা। সাউণ্ড ও কথা ঠিক মতো শুনা যাচ্ছেনা। শিক্ষকরা তাড়াহুড়া করে কোন একটা বিষয়ে লেকচার দিয়েই চলে যাচ্ছেন। অনলাইন পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সব পড়া সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। আর না বুঝলে শিক্ষকদের কাছে আবার প্রশ্ন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। আবার অনেকের সুযোগ থাকার পরও ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা ক্লাসে থাকায় অনীহা প্রকাশ করছে।
অনলাইনে ক্লাস শুরু করার চিন্তা নিঃসন্দেহে ভাল কিন্তু সরকারকে আগে চিন্তা করতে হবে আমরা বাস্তবিক অর্থে কতটা ডিজিটাল হতে পেরেছি বা আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কি অনলাইন ক্লাসের সুযোগ সুবিধা নিতে পারছে বা কতটা নিতে সক্ষম। বাস্তবতা হলো ভিন্ন — এখনো অনেক শিক্ষার্থীর ডিজিটাল ডিভাইস নেই। শুধু তাই নয় গ্রামীণ পর্যায়ে এখনো ইন্টারনেট সুবিধা পর্যপ্ত নয়। তাছাড়া ইন্টারনেট বা ইন্টারনেটের খরচ করার সামর্থ অনেক শিক্ষার্থীর নেই
। মেনে নিলাম বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাসে অংশগ্রহণে প্রস্তুত, কিন্তু বাকি শিক্ষার্থীদের তাহলে কি হবে? এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগ যেন ফুটো পাত্রে পানি ভর্তি করার প্রতিযোগিতার মতই।”
সরকারি হিসেবে দেশে প্রাথমিক স্কুল আছে ৬৪ হাজার আর অন্যদিকে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক স্কুল আছে আরও সতের হাজারের মতো। কলেজ বা মহাবিদ্যালয় আছে প্রায় আড়াই হাজার। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। যদিও এর মধ্যে অল্প একটি অংশই এই করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে আর টিভি দেখার সুযোগ আছে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর। অর্থাৎ এখনো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।
অনলাইন ক্লাস পরীক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শুধু বেতন আদায় করলে হবে না। সব শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে সবার অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের সরকারকে শিক্ষাখাতে নজর দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের ও শিক্ষকদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ,কম্পিউটার, স্মার্টফোন দিয়ে অনলাইন ক্লাসের জন্য সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। সব ছাত্রছাত্রীদের ও শিক্ষকদের জন্য বিনামূল্যে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা দিতে হবে। হাওর অঞ্চল, দুর্গত এলাকা সারাদেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক থাকতে হবে তবেই অনলাইন ক্লাসের সুফল মিলবে।
লেখক: আবু তাহের মিয়া
সহকারি শিক্ষক (বাংলা)
তাড়ল উচ্চ বিদ্যালয়, দিরাই, সুনামগঞ্জ।