সুনামগঞ্জ জেলার পরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এডভোকেট দিগ্বিজয় চৌধুরী শিবু আর নেই। বুধবার সকালে নিজ বাস ভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তিনি স্ত্রী ও দুই পুত্রসহ অসংখ্য আত্নীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে মারা যান। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের বিভিন্ন মহল। একই পাড়ার বাসিন্দা বন্ধুপ্রতীম রওনক আহমদ বখ্ত তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন।
ফেইসবুক বদৌলতে সকাল ৮ টায় দেখতে পেলাম ছবি, বন্ধু অ্যাড. দিগ্নিজয় চৌধুরী শিবু না ফেরার দেশে চলে গেছে। দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হতেই মেয়ে জিজ্ঞেস করল বাবা কি হয়েছে। সে তাকে চিনতে না পারায় বুঝতে পারল, উনি মৃত্যুবরণ করেছেন। বললাম-বাবা আমরা প্রায় ৪৬ বছরের সাথী ছিলাম। এরই মধ্যে উৎপল খাসনবীস বাবুর ফোন। দুজনই প্রায় বাকরুদ্ধ, কিন্তু বাস্তবকে মেনে নিতেই হবে। স্মৃতির পাতায় জল জল করে উঠল তাকে শেষ বারের মত দেখে। আমি ও উৎপল এক সাথেই তার মল্লিকপুর বাসায় গিয়ে হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখতে হয়েছে। তার স্ত্রীর কান্না থামছিল না আমাদের দেখে। সান্তনা দেয়ার ভাষা ছিল না আমাদের।
সমসাময়িক বয়স হওয়ায় প্রতিনিয়ত চলতো কথার আড্ডা। যদিও দুটি চোখ অসময়ে হারাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু মনোবল ছিল অটুট নিজে অসুস্থ কখনো প্রকাশ করতো না। ৫ম শ্রেণী থেকেই স্কুল সহপাঠী হওয়ায় তার গভীরত্ব সহজেই অনুমেয়। সাংস্কৃতিক পরিবারে বেড়ে উঠা শিবু সহজে সংগীত জগতে প্রায় একচ্ছত্রভাবে স্থান করে নিয়েছিল। উস্তাদ গোপাল চন্দ্রের সংস্পর্শে আসায় তার পরিধি ব্যাপক আকার ধারণ করে। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রয়াত তথ্যমন্ত্রী কুরবান আলী সুনামগঞ্জ সফরে আসলে আমরা দুইজন পুরাতন শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন সার্কিট হাউসে উনার সাথে দেখা করে সিলেট বেতারে আমাদেরকে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিতে অনুরোধ করি। যদিও নিয়ম হলো কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা, কিন্তু না বুঝেই উনার কাছে চলে যাওয়া। উনি কাছে বসিয়ে বললেন, বাবারা সিলেট বেতারে কণ্ঠস্বর পরীক্ষা দাও। উত্তীর্ণ হলে গান গেতে পারবে। আমি তোমাদের জন্য দোয়া করব।
পরবর্তীতে দুজনই সিলেট বেতারে সুযোগ পেয়ে গান করেছি। তখন মনে হতো সংগীতই জীবন। ১৯৭৮ সালে উৎপল বাবু আমাদের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত হয়ে সংগীত ভুবনে প্রবেশ করেন। এসময় পূরবী শিল্পী সংস্থা নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করি। সাথে ছিলেন দেওয়ান মহসীন রাজা, অভিজিৎ চৌধুরী, আব্দুর রব, দিলোয়ার হোসেন, সাব্বির আহমদ সোহেল প্রমুখ। যার কর্ণধার হিসাবে উৎপল খাসনবীশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক সংগঠন কণ্ঠ শিল্পী সংস্থা গঠন করা হয়। এতে সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ জন। এই সংগঠনের সভাপতি হিসাবে শিবুকে অনেক দিন থাকতে হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি এবং দাপ্তরিক দায়িত্বে ছিলেন উৎপল বাবু।
উল্লেখ্য আমি ও শিবু বিদেশ সফরে যাওয়ায় সংগঠনের হাল ধরেন দেওয়ান মহসীন রাজা ও উৎপল বাবু। পরবর্তীতে সংগঠনকে আরও গতিশীল করতে মলয় চক্রবর্তী রাজু ও সাব্বির আহমদ সোহেল অগ্রণী ভ’মিকা পালন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন তারা। যা আজও সুনামগঞ্জের মানুষের মনে গাঁথা রয়েছে। শিবুর কৃতিত্ব ছিল, সংগীত জগতের প্রতিটি বিভাগেই সমান বিচরণ ছিল তার। ১৯৭৭ সালে ৪টি মহকুমা নিয়ে অপরূপা’৭৭ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সিলেট স্টেডিয়ামে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাবু অনিয়েশ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে আমরা হাছনরাজার গান গেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করি এবং প্রথম পুরস্কার আমরাই গ্রহণ করি। শিবুর সংগীত নিয়ে আমার লিখনি মনে হয় আজকের মতো সমাপ্তি টানতে হবে। তাকে হারিয়ে আমি আবেগতাড়িত। সময় ও সুযোগ পেলে আরও লিখার প্রুত্যাশা করছি।
বন্ধু উৎপল খাসনবীশ এবং আমি দুজনই ভারাক্রান্ত। উৎপলের সহযোগিতা নিয়েই বন্ধু শিবুকে নিয়ে লিখা এই স্মৃতিচারণ। তাকে নিয়ে অনেক লিখার আছে। আজ এপর্যন্তই। আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক