বিশেষ প্রতিনিধি::
মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের বালাট সাবসেক্টরের অধীনে সুনামগঞ্জের ডলুড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থান। ১৯৭১ সনে এই সাব-সেক্টরে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন বাংলার দামাল সন্তানরা। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে এসে সমবেত হয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করার দৃপ্ত শপথে পরিবারকে না জানিয়ে অনেকেই যুদ্ধে এসেছিলেন। তাই তাদের যুদ্ধের খবর জানতোনা পরিবারের লোকজন। দেশ স্বাধীন করে অনেকে বিজয়ের বেশে পরিবারের কাছে ফিরলেও সম্মুখযুদ্ধে শহিদ ৪৮ জন যোদ্ধাকে ডলুড়া সীমান্তে গণকবর দেন মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক স্বজনরাও জানতেন না শহিদ স্বজনের কথা। মুক্তিযুদ্ধে সেই শহিদদের গণসমাধি স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর দৃষ্টিনন্দন উন্নয়নের মাধ্যমে সংস্কার করে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ফলক লাগানো হয়েছে। শহিদ স্বজনদের নিয়েই গত ৪ সেপ্টেম্বর সেই সংস্কারকাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর শহিদের স্বজনরা স্বজনের কবরে অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। শুকিয়ে যাওয়া চোখে জলের ধারা বইয়ে দিয়েছেন তারা। তবে এই ৪৮ জনের সঙ্গে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা মধু মিয়াকেও সমাহিত করা হয় তার ইচ্ছে অনুযায়ী।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা গেছে ১৯৭১ সনে বালাট সাবসেক্টরের যোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাদের মধ্যে ৪৮ জন শহিদের লাশ সংগ্রহ করে ডলুড়া সীমান্তে সমাহিত করেন সহযোদ্ধারা। ওই গণকবরে শুধু নম্বর ও নাম দিয়ে কবরগুলো কোনরকম চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরে সেখানেই পিলারের উপর নম্বর ও কেবল নাম বসিয়ে মুক্তিসংগ্রাম স্মৃতিট্রাস্ট কিছু কাজ করে। ডলুড়া শহিদ মিনার এলাকায় ব্যক্তিগত অর্থায়নে কিছু সংস্কারকাজ করেন বাঁশতলা সাবসেক্টরের অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন এএসএ হেলাল উদ্দিন। পরে বিভিন্ন সময়েও কিছু সংস্কার কাজ করা হয়। কিন্তু এতদিন শহিদদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উদ্ধার করে কবরে স্মৃতিফলক লাগানোর কোন উদ্যোগ ছিলনা।
গত বছর সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও মুুক্তিসংগ্রাম স্মৃতিট্রাস্ট ডলুড়া গণকবরে সমাহিত সকল শহিদের পরিচয় উদ্ধারে উদ্যোগ নিয়ে দৃষ্টিনন্দন সংস্কারে হাত দেয়। মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান ও মালেক হোসেন পীর বিভিন্ন স্থান থেকে শহিদদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা সংগ্রহ করে দেন। শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহিত এই পূর্ণ ঠিকানা নাম ঠিকানা ফলক বসিয়ে মার্বেল পাথরে খোদাই করে দেওয়া হয়েছে। সমাধিগুলোকে স্তরে স্তরে সুবিন্যাস্ত করে আকর্ষণীয়ভাবে বসানো হয়েছে। নির্মাণকাজ উদ্বোধনকালে ডেকে আনা হয়েছিল শহিদের স্বজনদের। তাদেরকে নিয়েই নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়।
এই শহিদ সমাধী সৌধের ফলকে ৪৮ জন শহিদের মধ্যে ৪৫ জন শহিদের পূর্ণ ঠিকানা সম্বলিত ফলক বসানো হয়েছে। তিনজের কেবল নাম রয়েছে। শহিদ গণসমাধীতে সম্মুখযুদ্ধে শহিদ ৪২জন মুসলিম যোদ্ধা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬জন যোদ্ধাকে একই কবরে সমাধীস্থ করেছিলেন সহযোদ্ধারা। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে যারা লড়েছিলেন সেই কবরই যেন তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। ধর্ম-বর্ণ ভুলে একই কবরে সমাহিত আছেন বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ট সন্তানরা।
ডলুড়া গণকবরে সমাহিত শহিদরা হলেন, জামালগঞ্জের মন্তাজ মিয়া, কম্পানিগঞ্জের তারা মিয়া, জামালগঞ্জের আলা উদ্দিন, সুনামগঞ্জ সদরের আবেদ আলী, সাতকানিয়া চট্টগ্রামের রহিম বক্স, পাংশা রাজবাড়ির আতাহার আলী, বিশ্বম্ভরপুরের জবান আলী, বিশ্বম্ভরপুরের লাল মিয়া, অষ্ট্রগ্রাম কিশোরগঞ্জের তাহের মিয়া, কটিয়াদি কিশোরগঞ্জের চান্দ মিয়া, কালিসাজুরি তাহিরপুরের আব্দুল হক, শহিদ সমুজ আলী, বাশগাড়ি ভৈরবের মুজিবুর রহমান, শহিদ সিদ্দিকুর রহমান, রফিনগর দিরাইয়ের মো. নূরুল ইসলাম, শহিদ ধানু মিয়া, নিকলী কিশোরগঞ্জের আব্দুল করিম, শহিদ মন্নাফ মিয়া, মঙ্গলকাটা সুনামগঞ্জের সুরুজ মিয়া, পাকুন্দিয়া কিশোরগঞ্জের রহিম মিয়া, দেওতৈল নবীগঞ্জের মো. ওয়াছিদ আলী, জিনারপুর বিশ্বম্ভরপুরের আলী আহমদ, ঝরঝরিয়া সুনামগঞ্জের সাজু মিয়া, বাউরবাগ গোয়াইনঘাটের মো. সিদ্দিক আলী, নুরুজপুর সুনামগঞ্জের মো. ধনু মিয়া, গজারিয়া কিশোরগঞ্জের মো. এ বি সিদ্দিক, বাউরবাগ গোয়াইনঘাটের মো. ফজলুল হক, গামাইরতলা বিশ্বম্ভরপুরের মো. ছায়েদুর রহমান, সৎপুর বিশ্বনাথের মো. শামসুল হক, বলরামপুর মৌলভীবাজারের মো. রহমত আলী, জয়নগর জগন্নাথপুরের মো. জয়নাল আবেদীন, পাঠানচক জকিগঞ্জের মো. আব্দুল হামিদ খান, কাইয়ারগাও সুনামগঞ্জের মো. মরম আলী, গোয়াইনঘাটের মো. আবু সিদ্দিক, কাছিরগাতি বিশ্বম্ভরপুরের মো. আব্দুর রহমান, করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের মো. আব্দুল খালেক, কটিয়াদি কিশোরগঞ্জের শহিদ কেন্তু মিয়া, মজলিশপুর ওসমানীনগরের যোগেন্দ্র নাথ, সাধুহাটি মৌলভীবাজারের মো. মোস্তফা মিয়া, পাহাড়পুর আজমিরিগঞ্জের শ্রীকান্ত দাস, বিতরগুল গোয়াইনঘাটের আব্দুস সাত্তার, কাগাপাশা বানিয়াচংয়ের হরলাল দাস, দুখড়ি সিলেটের মো. আজমান আলী, কাগাপাশা বানিয়াচংয়ের অধীর দাস, কুড়িগাই কিশোরগঞ্জের মো. সিরাজ মিয়া, সুনামগঞ্জ সদরের অরবিন্দু রায়, বনগাও নবীগঞ্জের মো. শামছু মিয়া এবং পাথারিয়া দক্ষিণ সুনামগঞ্জের কবিন্দ্র দাস। ৪৮টি শহিদের নাম ও পরিচয় মার্বেল পাথরে লিখে দৃষ্টিনন্দন নামফলকে লাগানো হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, আমি আর সহযোদ্ধা মালেক পীর শহিদদের ঠিকানা সংগ্রহ করেছি গত এক বছর ধরে। সেগুলো মুক্তিসংগ্রাম স্মৃতিটাস্টের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দিয়েছি। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর ডলুড়া গণকবরে সমাহিত শহিদদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা সম্বলিত স্মৃতিফলক বসিয়ে দৃষ্টিনন্দন কাজের উদ্বোধন করায় আমরা খুশি। এই সুযোগে শহিদদের স্বজনরা এসেও স্বজনের কবর দেখে গেছেন। তারা আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের জল ফেলেছেন সমাধীতে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ডলুড়া শহিদ সমাধীসৌধ দৃষ্টিনন্দন কাজ শহিদের স্বজনদের দিয়েই উদ্বোধন করিয়েছি আমরা। ৪৯ বছর পর পূর্ণ ঠিকানা বসানো হয়েছে। কাজটি যাতে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় হয় সবধরনের উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে।