১৯৪৮ সন থেকেই জঙ্গলাকীর্ণ বড়গোপটিলায় আশেপাশে মান্দি ও হাজংরা খেলাধূলা শুরু করেন। ধীরে ধীরে এটি ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ হিসেবে গড়ে ওঠে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের উত্তর বড়দল ইউনিয়নের রাজাই মৌজায় অবস্থিত এ মাঠে প্রতিবছর ফুটবল-ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, জাতীয় দিবস পালন, আদিবাসী দিবসের নানা সামাজিক আয়োজন হয়। লাউড়েরগড়ের চারধার দখল হয়েছে বাইরে থেকে আসা বাঙালি অভিবাসনে। এর নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐতিহাসিকতা আছে। কেবল জমি নয়, দখল হয়েছে জংগল, জলাভূমি কী হাওর। এমনকি নদীও। বাকী আছে একটুকরো শীর্ণ লাউড়েরগড় টিলা। মান্দিরা বলেন ‘বড়গোপটিলা’। ঐতিহাসিক লাউড়রাজ্যের শেষ প্রাকৃতিক স্মৃতিচিহ্ন এই লাউড়েরগড়। যাদুকাটা নদীর ধারের এই টিলা পবিত্র পণাতীর্থ এবং শারফিন মোকামেরও অনন্য অংশ। একসময়ের দুর্গম ও বিশাল ‘ইকর-আটিয়া বনের’ এই জীর্ণ টিলা ছাড়া কিছুই আজ নেই। প্রাচীন শিমূলতলীর গহীন শিমূলবন এখন নেই। যদিও পাশের শিমূল বাগানটি সম্প্রতি গড়ে ওঠেছে। একটা সময় পণাতীর্থ আর শারফিনের মোকামে আসা মানুষেরাই লাউড়েরগড় টিলা দর্শন করতেন। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। লাউড়েরগড়, পাশের শিমূল বাগান, যাদুকাটা নদী, হাওর, পেছনের মেঘালয় পাহাড় আর আদিবাসী গ্রাম ঘুরতে দলে দলে আসছে মানুষ। আগেও জমিজমা নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে বাইরে থেকে আসা বাঙালিদের বিবাদ হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি এর সাথে যুক্ত হয়েছে করপোরেট পর্যটন বাণিজ্য মনস্তত্ত্ব। লাউড়েরগড় আবারো বাইরে থেকে আসা বাঙালিদের দখলের নিশানা হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারির বিপদকে তোয়াক্কা না করে লাউড়েরগড়ের ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ দখলে মরিয়া হয়েছে কিছু মানুষ। চলতি ২০২০ সনের ৭ সেপ্টেম্বর স্থানীয় মান্দিরা মাঠটি ফেরত চেয়ে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। জেলা প্রশাসকের কাছেও আবেদন করেছেন। ১৩ সেপ্টেম্বর বড়গোপটিলা মাঠে এ বিষয়ে এক সালিশ বসে। বৈঠকে সালিশকারীরা মাঠ প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে মান্দিদের ভূমিকা স্বীকার করেন। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই ঐতিহাসিক মাঠ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তাকে প্রত্যাখান করেছেন এই মাঠের সূচনাকারী এবং ৭২ বছর ধরে এই মাঠের ব্যবস্থাপক স্থানীয় মান্দি জনগোষ্ঠী। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ও বিবাদ বহাল আছে। পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি বালিতে ক্ষয়ক্ষতি, বারকি শ্রমিক এবং পণাতীর্থ বিষয়ক খবর ছাড়া দীর্ঘদিন বাদে এই হাওর সীমান্ত অঞ্চলটি আবারো গণমাধ্যমে শিরোনামে পরিণত হলো। প্রথমত প্রশাসন একতরফাভাবে ঐতিহাসিক, পবিত্র এবং বাস্তুসংস্থানগতভাবে সংবেদনশীল এই লাউড়েরগড় ও ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ বিষয়ে কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এই অঞ্চলের প্রতিবেশ, জনসংস্কৃতি, জনমিতি, জনইতিহাস এবং স্থানীয় সংরক্ষণ কৌশলগুলো বিষয়ে জানাবোঝা থাকাটা জরুরি। রাষ্ট্র প্রতিটি উপজেলায়, ইউনিয়নে ‘রিসোর্স সেন্টার’ এবং ‘তথ্যকেন্দ্র’ গড়ে তুলেছে। এসব কেন্দ্রে সেই অঞ্চলের ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনমিতির নথিদলিল থাকবার কথা। যদি মূদ্রিত দলিল হাতের নাগালে না থাকে? সেক্ষেত্রে ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ বিষয়ে চলমান বিবাদের মীমাংসার জন্য স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালি সকল প্রবীণজনের স্মৃতিভাষ্য এবং মৌখিক জনইতিহাস বিশ্লেষণ ছাড়া আর কোনো সহজ বৈজ্ঞানিক উপায় নাই। বাংলাদেশ এই মৌখিক জনভাষ্যের ভেতর দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের মহাবয়ান গড়ে তুলছে। আর আমরা একটা খেলার মাঠের বিবাদ মেটাতে পারবো না? অবশ্যই পারতেই হবে। তা না হলে ঐতিহাসিক লাউড় পরগণা এবং ইকর-আটিয়ার বনের প্রতি আমাদের অবিচার করোনাকালের এক দগদগে ভুল হিসেবেই জনইতিহাসে নথিভূক্ত হয়ে থাকবে। নিশ্চয়ই তাহিরপুরের প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিগণ এই ঐতিহাসিক ভুলটি করবেন না। দ্রুত ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ নিয়ে উত্থিত বিবাদের অবসান হোক। আর এরজন্য স্থানীয় মানুষের ভাষ্য, প্রমাণ, নথির প্রতি আমাদের আস্থা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তি মজবুত করতে হবে। চলতি আলাপখানি ‘বড়গোপটিলার গারো মাঠ’ ন্যায্য সিদ্ধান্ত নিতে জনইতিহাসের কিছু ভাষ্য ও প্রমাণ হাজির করছে।
ঐতিহাসিক লাউড় পরগণা
শ্রী অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (পূর্বাংশ)’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯২০ খৃস্টাব্দে। বইটির দশম অধ্যায়ে আছে, প্রাচীনকালে শ্রীহট্ট লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তীয়া এই তিনভাগে বিভক্ত ছিল। ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থকে উদ্বৃত করে তিনি জানান, স¤্রাট আকবরের সময় (১৫৪২-১৬০৫) শ্রীহট্ট জেলা আটটি মহলে বিভক্ত ছিল। এর ভেতর লাউড় একটি মহল। অচ্যুতচরণ লিখেন, লাউড়ের রাজস্ব ছিল ২,৪৬,২০২ দাম। দাম হলো ডবল পয়সার মতো একপ্রকার তা¤্রমূদ্রা। আট দামড়ীতে এক দাম এবং চল্লিশ দামে এক শেরশাহী টাকা ছিল তখন গণনার হিসাব। আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী তোডরমল্ল কর্তৃক প্রস্তুত রাজস্ব হিসাবে লাউড়ের এই রাজস্ব হিসাব বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীতে এই অঞ্চল সুসঙ্গ রাজার শাসনে আসে। ১৯৫০ সনে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। লাউড় পরগণার বনভূমি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আসে। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলটি মেঘালয় পাহাড়ের কোলে যাদুকাটা, মাহারাম, রক্তি, পাটলাই নদীবিধৌত এবং হাওরবেষ্টিত। এককালে লাউড় ও মাহারামে ছিল গভীর ইকর-আটিয়ার বন। এখানেই গড়ে ওঠেছে পবিত্র অঞ্চল পণাতীর্থ ও শারপিন মোকাম। মনবেগ, হাবেলীর মতো লাউড়ের আদিগ্রামগুলোর এখন কোনো হদিশ নেই। মান্দি, হাজং, কোচ, বানাই, লেঙ্গামরাই এই অঞ্চলের আদি বসতিস্থাপনকারী।
শিমূলতলী ও মানিগার নরখাদক
সুনামগঞ্জের সেলবরষের জমিদার বংশে ১৩০৩ বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন আবদুর রহমান চৌধুরী। তৎকালীন ডেপুটি কমিশনারের অনুরোধে তিনি তার শিকার জীবনের শেষ বাঘটি শিকার করেন লাউড় জংগলে। ‘জানোয়ারের খাসমহল’, ‘শিমূলতলীর নরখাদক’ ও ‘মানিগার নরখাদক’ নামে তার তিনটি বই আছে। তাঁর বইতে লাউড় পরগণার দুর্গম জংগলের কিছুটা পরিচয় মেলে। ‘মানিগার নরখাদক’ বইতে তিনি লিখেছেন, …পূর্ব দক্ষিণে লাউড়ের গড় রিজার্ভ ফরেস্ট। সেখানে পশুশিকার নিষিদ্ধ। নদী-তীরের শিমূলবন ও লাউড়েরগড়ের উঁচুভূমির মাঝখানে ধূ-ধূ বালুচর দিয়ে হাঁটা পথে অনেকে শারপিন মোকামে যায়। যাত্রীরা নদীর তীরে পাতলা ঝোপঝাড়ে প্রায়ই বাঘকে বিচরণ করতে দেখে। ২০০৬ সনে রাজাই, কড়ইগড়া, মাঝিটিলা, ভুরঙ্গাছড়া, লালঘাট, বড়গোপ, মাছিমপুর, চানপুর গ্রাম থেকে আমি নিজেও এই অঞ্চলের বন্যপ্রাণীদের নানা আদি বিবরণ সংগ্রহ করি। এমনকি এই অঞ্চলে নতুন বসতিস্থাপনকারী বহিরাগত বাঙালিদের অনেকের বাঘ-দর্শনের স্মৃতি আছে। ১৯৬২ সনে কিশোরগঞ্জের নিকলীর কাশীপুর গ্রাম থেকে এসে উত্তর বড়দল ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন মহরম আলী। তার বাড়িতে এসে বাঘ গরু মেরে গিয়েছিল।
সাতদিনের আগুন, ‘আবাদীদের’ আগমন
মহাভারতের ‘খান্ডব বন’ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ‘আমাজন বন’ সবই পুড়েছে লোভের আগুনে। পুড়িয়েছে বাইরে থেকে আসা মানুষেরা আর তাদের মুনাফার লোভ। পঞ্চাশের দশকে আসামের ‘বাঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলনে বিতাড়িত হাজার হাজার আশ্রয়হীন লোক সুনামগঞ্জের এই সংরক্ষিত বনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা ঐতিহাসিক এই বনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সাতদিন সাতরাত ধরে আগুনে পুড়ে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায় এক প্রাচীন অরণ্য। এভাবেই ইকর-আটিয়ার গহীন বন বহিরাগতদের মাধ্যমে আবাদী কৃষিজমিনে পরিণত হয়।
নিরুদ্দেশ ইকর-আটিয়ার বন
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর সীমান্তে মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম খাসি পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় পঞ্চাশ মাইল বিস্তৃত লাউড় ও মাহারাম বনের কথা জানা যায়। ইকর-আটিয়ার জংগল নামে পরিচিত এই বনে নল, নটা, খাগ, ইকর, কাশ, বিন্যাছুবা, বনতুলসী, বুনোগোলাপ, ছণ, বেতন, বাঁশের আধিক্য ছিল। জলাভূমিতে ছিল হিজল, করচ, বরুণ, কদম, মূর্তার বাগ। গভীর এই বনে বাঘ, চিতা, খাটাশ, সজারু, বনরুই, ভালুক, শূকর, শিয়াল, হরিণ, অজগর, মহিষ, তারা বাঘসহ দেখা যেত বিরলসব পাখপাখালি। ১৭০০ সনে বাংলার শেষ স্বাধীন ভূস্বামী খাজা ওসমান লাউড় জংগলের ভেতর দিয়ে সিলেটে পৌঁছান। দেশভাগের পর এই বন নি:শেষ হতে থাকে। ১৯৮৮ সনে মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত ‘মানিগার নরখাদক’ বইতে সম্পাদক খলিল চৌধুরী লিখেছেন, …একসময় কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকা থেকে মানুষ এসে এই বনের ইকর, ছণ, নল, বেত, বাঁশ কেটে নিত। পাকিস্থান আমলে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালী, কুমিল্লা থেকে দলে দলে লোক এসে নামমাত্র মূল্যে বনভূমি খরিদ করে বনধ্বংসে লেগে যায়।
হারানো হাওর, হারানো নদী, হারানো গ্রাম
‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ নিয়ে সাম্প্রতিক বিবাদ কোনোভাবেই ‘আদিবাসী-বাঙালি’ দ্বন্দ্ব নয়। এই বিবাদের ময়দান থকে এর সমাধানও সম্ভব নয়। এর কারণ আরো উজানে, আরো ভাটিতে। প্রথমত এখানে উজান-ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। দুনিয়ার সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত সুনামগঞ্জের এই তাহিরপুর সীমান্ত। উজান থেকে ভাটিতে পাহাড়ি ঢল আগে প্রাকৃতিক জংগল বেষ্টনীতে বাধা পেয়ে একটা ব্যাকরণ নেমে ভাটিতে নামতো। পাকিস্থান আমল থেকেই এই গণিত মানুষ গায়ের জোরে বদলে ফেলেছে। এখন বছর বছর পাহাড়ি ঢলে তলায় হাওর। মেঘালয় পাহাড়ি আছে অপরিকল্পিত কয়লা ও পাথরখনি। এখন কেবল পানি নয়, পাহাড়ি বালিতে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে সীমান্তের একের পর এক হাওর, নদী ও গ্রাম। এই অবস্থা স্থানীয় ভূমি-ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহারে তৈরি করছে নতুন সংকট। নয়া বিরোধ। পচাশৌল নামে এক হাওর ছিল উত্তর বড়দল ইউনিয়নে। মেঘালয় পাহাড় থেকে ভোলাঠাক্কর নদী, কড়ইগড়া ছড়া, ভুরঙ্গাছড়া নদী, বড়ছড়া নেমেছিল হাওরে। যাদুকাটা নদীর একটি ডাল লাউড়ের গড় টিলার কাছে মাহারাম নদী হয়ে পচাশৌলে প্রবেশ করেছে। ১৯৬৭ সনে নয়াবসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের সরকারিভাবে পরিবারপ্রতি পচাশৌলের ১০ কেয়ার করে জমি তিনসনা বন্দোবস্তী হিসেবে দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে পাহাড়ি বালিতে পচাশৌল ভরাট হতে থাকে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় একেবারে ভরে যায় পচাশৌল আর মাহারাম গ্রামের মানুষেরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। নতুন চরজমি নিয়ে তখনি স্থানীয় মান্দিদের সাথে শান্তিপুরের নয়াবসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের বিরোধ হয়। ঘর হারিয়ে অনেক বাঙালি আশ্রয় নেয় লাউড়ের গড় টিলায়। পাহাড়িটিলা জংগলে অনভ্যস্ত বাঙালিরা সমানে জংগল-টিলা কেটে আবাদ ও বসতির বিস্তার ঘটায়। ২০১৮ সনে লাউড়েরগড়ের পাহাড় কাটা, বননিধন এবং অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন উদ্যোগ নেয় এবং এ নিয়ে মামলাও হয়। কিন্তু হাওর সীমান্তের এই ভূমি-বিবাদ থামেনি। যদি উজান-ভাটির অন্যায় উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে না থামানো যায়, যদি বছরের পর বছর পাহাড়ি বালিয়ে মানুষের সহায়-সম্বল সব হারায় তবে ভবিষ্যতে এই সংকট আরো তীব্র ও জটিল হবে। কেবলমাত্র ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ নয়, সীমান্তের সামগ্রিক ভূমিসম্পদ নিয়েই তৈরি হবে নির্দয় দরবার। ভূমিদখলে বাঙালিরা আরো মরিয়া হবে। অধিকতর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে মান্দি-হাজংরা হারাবে ভূমির অধিকার। এর সাথে যুক্ত হতে থাকবে বাণিজ্যিক মুনাফা, লুন্ঠন, ক্ষমতা ও দলীয় রাজনীতির বাহাদুরি।
একটি খেলার মাঠ?
‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ কেবল একটি খেলার মাঠ নয়। লাউড়-মাহারাম অরণ্যের শেষ প্রাকৃতিক স্মৃতিচিহ্ন। প্রায় ৩১২ একর এই টিলা এখন ১নং খাসখতিয়ান ভূমি। এই টিলার পাশে রাজাই গ্রামের রেনসিং সলোমার (জন্ম ১৯৩১) ২০০৬ সনে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, লাউড়েরগড়ে লেঙ্গাম জনগোষ্ঠীর বেশকিছু পবিত্র ‘এ্যাইং (পূজাস্থল)’ ছিল। বেসাকিন্নাহ, সয়কিন্নাহ, দমব্লি পূজা হতো এখানে। এখানকার টিলাপাহাড়ে লেঙ্গামরা ‘স্তাউলাংখা (জুমচাষ)’ এবং মান্দিরা ‘হাবাহুয়া (জুম)’ করতো। বাঙালভিটা গ্রামের মিনোমনি দাজেল (জন্ম-১৯২১) তার মা রংশি দাজেলের সাথে এই টিলায় জুমআবাদ দেখেছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলেও আশেপাশের মান্দি, হাজং, লেঙ্গামরা এই টিলা থেকে বনআলু, পাহাড়ি ফল ও ভেষজগুল্ম সংগ্রহ করতেন। হেমন্তে এখানে কিছু খেলাধূলাও হতো। দেশভাগের পর মেঘালয়ের নংস্টইন রাজ্যের রাজা উইকক্লিফ সিয়েম রাজাই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তার পরের বছর ১৯৪৮ এই টিলায় মান্দিরা একটি সুপরিসর খেলার মাঠ গড়ে তুলেন। সরকারি প্রকৌশলী রাজা উইকক্লিফ নিজেও এই মাঠে খেলাধূলা করেছেন। পাশের লালঘাট হাজং গ্রামের টংকবিপ্লবী হেমেন্দ্র চন্দ্র সরকার (জন্ম ১৯০৪) বলেছিলেন, এই মাঠে মান্দি ও হাজংরা নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করতেন। ধর্মপাশার বহরাতলীর ক্যামনাথ বানাই (জন্ম-১৯৪১) থেকেও একই ভাষ্য শুনেছি। মান্দিরা এই মাঠের দেখভালের দায়িত্বে ছিল বলে এই মাঠটি ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৬৮ সনে বারিক্যা মিয়া নামে এক প্রবীণ বাঙালি এই টিলায় বসবাস শুরু করলে টিলাটি নতুনভাবে ‘বারিকের টিলা’ হিসেবেও পরিচিতি পায়। এই টিলায় কেবল খেলার মাঠ নয়; পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীর গভীরতা মাপক কেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয়, খৃষ্টীয় মিশনারী বিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক, গির্জাঘর ও মসজিদও গড়ে ওঠেছে। সকল জনভাষ্য ও জনইতিহাস প্রমাণ করে লাউড়েরগড়ের আদিবাসিন্দা মান্দি, হাজং, লেঙ্গাম জনগোষ্ঠী। বাঙালিরা এখানে নানাভাবে পরে এসেছে। ‘বড়গোপটিলা গারো মাঠটির’ নির্মাতা, ব্যবস্থাপক ও সংরক্ষক স্থানীয় আদিবাসীরাই। দেশদুনিয়ায় এমন প্রমাণ নেই যে, বহিরাগতের কাছে প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ-ঐতিহ্য সুরক্ষিত থাকে। বড়গোপটিলা গারো মাঠটি স্বীকৃতিসহ আইনগতভাবে মান্দিদের কাছে ন্যস্ত করা হোক। বাইরে থেকে আসা বাঙালিরা এর মর্ম বুঝবে না। এটি তাদের সমস্যা নয়, তারা এই বাস্তুসংস্থানের সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ নন। কেবল একটি ঐতিহ্য এবং পাবলিক খেলার মাঠের জন্যই নয়, ঐতিহাসিক লাউড় পরগণার সর্বশেষ এই স্মৃতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা জরুরি। আর এই সংরক্ষণ তখনি জীবন্ত ও কার্যকর থাকবে যখন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততাকে আইনত স্বীকৃতি দেয়া হবে। খেলার মাঠটিসহ পুরো গড়টিলার সংরক্ষণের দায়িত্ব ও সামাজিক মালিকানা স্থানীয় জনগণের ওপর ন্যস্ত হবে। আমরা লাউড় কী মাহারাম বন বাঁচাতে পারিনি, পচাশৌল কী মাহারাম নদীটিও গেছে, লাউড় পরগণার সর্বশেষ প্রাকৃতিক স্মৃতি এই বড়গোপটিলা গারো মাঠটি কি সুরক্ষা করতে পারিনা? প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের প্রতি আর কত অবিচার? আর কত মুনাফা আর লুন্ঠন? নির্দয় করোনাকাল কী একটুও আমাদের মনে দাগ কাটবে না? আশা করি বড়গোপটিলা গারো মাঠের জনইতিহাসভাষ্যকে রাষ্ট্র আমলে নেবে। নিশ্চিত করবে লাউড়ের গড়ের ন্যায়বিচার।
……………………………………………………
লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: animistbangla@gmail.com