গোলাম সরোয়ার লিটন::
হাওর থেকে উৎপাদিত বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। এই ধানই হাওরপাড়ের অধিকাংশ পরিবারের খেয়ে বেঁচে থাকা আর পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটানোর প্রধান অবলম্বন। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি অনুভব করেছি, খরার কবলে পড়ে জমি যখন চৌচির হয়ে যায় তখন আব্বার বুক ফাটার আর্তনাত । টিনের চালে যখন শিলাবৃষ্টি পড়ত আব্বা-আম্মা নির্বাক হয়ে যেতেন। চোখে মুখে বিষাদরেখা ফুটে উঠত । হাওরের বাঁধের খারাপ খবর আসলে গ্রামজুড়ে কান্নার রোল উঠত। আজো এ অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। যখন বাঁধের অবস্থা খারাপ হয় বা বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে উৎপাদিত ধানের চারাগাছ তলিয়ে যায় তখন কিছু কথা হয়। চলে প্রতিযোগীতা দিয়ে প্রতিবাদ আর প্রতিশ্রুতি। পরে সারা বছর আর এ বিষয়গুলো তেমনভাবে জোড়ালে আলোচনায় আসেনা। হাওরপাড়ের কৃষকরাও নিয়তি মেনে সবকিছু ভুলে যান।
হাওরের বাঁধের কাজ ঠিকাদার বা পিআইসি যিনি করুন না কেন। তাদের মধ্যে বিরাট ভয় থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়না। উল্টোভাবে সবচেয়ে লাভজনক কাজ হয়ে ওঠেছে এই হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ। মুল কারণ হাওরপাড়ের সাধারণ কৃষক পরিবারগুলো প্রতিবাদী বা সচেতন না হওয়া। এর মধ্যে একশ্রেণীর শক্তিশালী সুবিধাভোগী তৈরী হয়েছে। আজ দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের নোয়ানগর গ্রামের একজন বলেছেন ঠিকাদার মেশিন দিয়ে মাটি কাটায় তার ৪০টি গাছ মাটি থেকে উপড়ে পড়ে গেছে। ঠিকাদার তার কথা না শুনে ইচ্ছে করেই শক্তি দিয়ে আর স্থানীয়দের ব্যবহার করে এমনটা করতে পেরেছে। হাওরজুড়েই চলছে মেশিন দিয়ে মাটিকাটার কাজ। বাঁধের পাশ থেকে বা বাঁধ থেকে কিংবা রাস্তার পাশ থেকে বা রাস্তা থেকে মাটিকেটে বাঁধ বা রাস্তা (আফর) করা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর আগে একটি সংস্থার করা হাওররক্ষা বাঁধের কাজ দেখতে হাওরে যাই। সেখানে বাঁধের কাজ দেখে খুবই আশান্বিত হয়েছিলাম। তারা বাঁধের মধ্যে প্রথমে বাঁশ ফাইলিং করে। পরে প্রতি এক ফুট বা দুই ফুট উঁচু করে মাটি ফেলে তাতে ভারি কোন কিছু দিয়ে আঘাত করে সেই মাটি শক্ত করে বসানো হয়েছে। এভাবে প্রয়োজনীয় উচ্চতায় এনে দুইপাশে বাশঁ দিয়ে আবার ও মাটি আটকে দেওয়া হয়। সেই বাশেঁর পর আবারও দুইপাশে তিন হাত প্রস্ত করে মাটি ফেলে আবারও বাঁশ দিয়ে এভাবে দুইপাশে আটকে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আবারও একইভাবে দুই পাশে তিন হাত প্রস্ত করে মাটি ফেলে বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। শেষে বাঁধের ওপর দুর্বাঘাস দিয়ে আবৃত্ত করা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এ পদ্ধতিটি একটি চমৎকার ও সেরা। তবে ওই সংস্থার লোকজন বলেছিল যে টাকা বাঁধে বরাদ্ধ ছিল তাতেই তারা এভাবে কাজ করতে পেরেছে। তবে কাজ শেষে লাভ কত হয়েছিল তা অবশ্য জানতে পারিনি।
আমরা হাওরবাসী এই দুর্যোগ থেকে যাতে রক্ষা পাই মহান আল্লাহর কাছে এই দোয়া করছি।
লেখক: শিক্ষক। গত দেড় দশক ধরে মূলধারার সাংবাদিকতায় জড়িত।