1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৫ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

আং শোংনাম হুং ।। পাভেল পার্থ

  • আপডেট টাইম :: মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪.০১ পিএম
  • ২৪৪ বার পড়া হয়েছে

চলতি আলাপখানির শিরোনামটি ম্রো ভাষায়। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আমিই শোংনাম পাহাড়’। শোংনাম পাহাড়ের মারমা নাম নাইতং। বাঙালিরা এখন নাম দিয়েছে ‘চন্দ্রপাহাড়’। এই সেই ‘চাঁদের পাহাড়’, যেখানে মার্কিন ম্যারিয়ট হোটেলের পর্যটন অভিযান নিয়ে তর্ক ওঠেছে। ম্রোভাষায় হুং মানে পাহাড়। শোংনাম হলো ভূতের পাহাড়। তেংপ্লংচ্যুত পাহাড়ের চূড়ায় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল বলেই এর এমন নাম। বাঙালিরা যার নাম রেখেছে ‘নীলগিরি’। দেবতা পাহাড়ের ম্রো নাম ‘সুঙনামনিয়ন চ্যুত’, সীতাপাহাড়ের নাম ‘তামখন চ্যুত’। শংখ/সাঙ্গু নদীর ম্রো নাম ‘টেপাকঅ’। ম্রো ভূবিদ্যাঅনুযায়ী পাহাড়, জংগল, গ্রাম, জুমের স্থাননাম গড়ে ওঠে নানাভাবে। এমনকি প্রথম বসতিস্থাপনকারীর নামেও কোনো জায়গা নাম পায়। ম্রো ভাষায় ‘ইয়াং বং হুং’ হলেও, চিমবক ম্রো’র নামে দেশের এক পরিচিত পাহাড়ের নাম হয়েছে ‘চিম্বুক পাহাড়’। চিম্বুক পাহাড়ের আদি ম্রো সভ্যতা আজ এক নিদারুণ উন্নয়ন-যন্ত্রণার মুখোমুখি। যন্ত্রণার নাম নয়াউদারবাদী বিলাসিতা। কী হতে চলেছে শোংনাম পাহাড়ে? বান্দরবান জেলা পরিষদের ভাষ্য, পর্যটনের জন্য শোংনাম পাহাড়ের ২০ একর ভূমি ৪০ বছরের জন্য লীজ দেয়া হয়েছে। যদিও ২০১২ সনে এই ভূমি লীজ বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল আঞ্চলিক পরিষদ। এখানে তৈরি হবে বহুজাতিক মার্কিন চেইন হোটেল ম্যারিয়ট। গণমাধ্যমে প্রকাশ, কেবল হোটেল নয়; ১২টি পাহাড় জুড়ে এই বিলাসি তান্ডব চলতে পারে। ক্যাবলকার (রোপওয়ে) হবে, বিনোদন পার্ক থাকবে। সেনা কল্যাণ ট্রান্ট এবং সিকদার গ্রুপ (আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস) বাংলাদেশে এই কাজটি সমন্বয় করছে। এই বিলাসী উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে গেলে কাপ্রুপাড়া, কলাইপাড়া, এরা পাড়া, দলা পাড়া ম্রো গ্রামগুলি নিরুদ্দেশ হবে। আশংকা, ভবিষ্যতে ম্রোদের ১১৬টি পাড়ার প্রায় ১০ হাজার মানুষ সংকটে পড়বে এবং বিপন্ন হয়ে ওঠবে হাজার একর পাহাড়ি বাস্তুসংস্থান। ৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ম্যারিয়ট হোটেল বন্ধ এবং জীবন-জীবিকা সুরক্ষার দাবিতে বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে প্লুং বাঁশী বাজিয়ে ‘কালচারালাল শোডাউন’ করেছে ম্রোরা। এ নিয়ে দেশজুড়ে তর্ক ওঠেছে, বিশেষত তরুণপ্রজন্ম এই উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে প্রবলভাবে প্রশ্ন করছে। শোংনাম পাহাড়ের এই বিনোদন প্রকল্পকে প্রাণ- প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জনবসতি বিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। করোনাকালের দমবন্ধ দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে এমন বিলাসী প্রকল্প ভাবতেও পারিনা! কেমন ক্লান্ত আর বিমর্ষ হয়ে ওঠে চারধার। করোনা মহামারী কী তাহলে কোনো বার্তাই জাগাতে পারলো না আমাদের কলিজায়? করোনাকাল প্রমাণ করলো প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা ছাড়া দুনিয়ায় বাঁচবার আর কোনো বিকল্প নাই। কী দরকার সুপ্রাচীন বসতি, পাহাড় আর বাস্তুসংস্থান তছনছ করে একটা ম্যারিয়ট হোটেল? কার বিনোদন আর বিলাসিতা এমন উছলে ওঠবে করোনা-উত্তর দুনিয়ায়? যার কাছে একটা পাহাড় আর ঝর্ণার চেয়ে প্রকট হয়ে ওঠবে মুনাফা। মাস্কঢাকা এই সময়ে তারপরও কেন যেন বারবার উঁকি দেয় শোংনামহুং আর চিম্বুকের টগবগ স্মৃতি। আমার শিক্ষাজীবনের একটা দারুণ সময় কেটেছে এখানে। ম্রোদের জুমবিদ্যা আর ইঁদুর-বন্যার বিজ্ঞান বুঝতে গিয়েছিলাম। ম্যারিয়টের মতো অধিপতি বিনোদনের বিরোধীতা করবার সাহস আমার নাই। চলতিআলাপ নিদেন কিছু স্মৃতিকথা। করোনাকালে আমার শিক্ষক আর শিক্ষায়তনের বিপন্নসব চেহারা উঁকি দেয়ার স্মৃতি।

কাপ্রুপাড়া বিদ্যাঘর

বান্দরবানের লামা উপজেলার ৫ নং সোরাই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজার ছংরুম ম্রো আর সাগওয়াক ম্রো ছিলেন আমার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক। ২০০৭ সনের মার্চ-এপ্রিল। আমরা ভোর রাতে ঘুম থেকে ওঠে জুমে যাবার প্রস্তুতি নিই। তারপর আবছা ভোরের পাহাড়ি পথে জুমজমিন। বিকেলে আমার ক্লাশ শেষ হতো। আমার দুর্বল স্মৃতি আর মেধায় কোনো একটা কিছু আয়ত্ত করতে দীর্ঘসময় লেগে যেত। ছংরুম ম্রো, লাইপাও ম্রো, সঙপিউ ম্রো, তুমদান ম্রো, তুমলেঙ ম্রো, ইয়মপাও ম্রো, সঙমুং ম্রো এবং খিয়ৎ ম্রো এই অসামান্য জ্ঞানী জুমিয়া নারীরা একেবারে ‘হাতে-দায়ে’ আমাকে শেখানোর চেষ্টা করেছেন জটিল ¤্রাে জুমবিদ্যা আর ইঁদুর-বন্যার বিজ্ঞান। ‘হাতে-কলমে’ বলতে বেশ প্রচলিত একটা চিন্তা আছে। এর মানে এই যে হাতে কলম বাদে আর কোনো শিক্ষা পদ্ধতি নাই। আমার এই ম্রো শিক্ষকেরা জানিয়েছিলেন, জুমবিদ্যা কোনো ‘হাতে-কলমের’ ব্যাপার নয়, বরং এটি ‘হাতে-দায়ের’ ব্যাপার। হাতে-কলমের নয় বলেই কি এই হাতে-দায়ের জ্ঞান কোনোভাবেই একতরফা হাতে-কলমের ব্যবস্থায় স্বীকৃতি পায় না। কেবল কাপ্রুপাড়া নয়, এমপুপাড়ার মেনপু ম্রো, নাংক্লেং ম্রো, সেকরে ম্রো, কাইয়্যুং ম্রো, কাইসং ম্রো, ইয়ারমেন ম্রো, সিংরাও ম্রো, সঙইয়ান ম্রো, চামারিং ম্রো, নান্টুম ম্রো, সুমিয়ন ম্রো, গানচং ম্রো, মুনথার ম্রো, ইরচং ম্রো সবাই হয়ে ওঠেছিলেন আমরা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। এভাবেই এক পাহাড়ি ম্রো গ্রাম হয়ে ওঠেছিল আমার এক বিস্ময়কর বিদ্যাঘর। আজ করোনাকালে শুনি একটা হোটেলের জন্য আমার সেই বিদ্যাঘর আর আমার ম্রো শিক্ষকেরা নিরুদ্দেশ হতে পারেন। খুব কষ্ট লাগে, নিদারুণ হয়ে ওঠে চারধার। বকে (জুমঘরে) বসে ভাতের সাথে কানপেংকান, ডেঙবংকান, লিংককুয়া, সাংফগান, রাইকান, মওগান, দেংরামকান নামের ম্রো খাবারের আহাজারি কেবল তড়পায়।

ওয়াহ্ ল্যুপ কী হারিয়ে যাবে চিম্বুকে?

জুমচাষকে স্থানীয়ভাবে ম্রো ভাষায় ওয়াহ্ ল্যুপ বলে। জুম আবাদের জন্য ম্রো নারীদের পছন্দ খাড়া উঁচু পাহাড়। ম্রো সমাজে জুম আবাদের ক্ষেত্রে কুরপাক-কুরছাক নামে একটি পদ্ধতি আছে। এটি সামাজিক সহযোগিতার একটি আদি কৃষিধরণ। একজনের জুমে অন্যজনের কাজে সহযোগিতা করা। চামকির ওয়াহ্, ওয়াহ্ চিয়াখিন, চিয়া ডিয়া, ওয়াহ্ তৌকখিন্, ওয়াহ্ রাত, চাসতখিন্, বেটরামা থাক্ খিন, বটওয়াই থাক্ খিন, বটসুম, রুইতাত, চাঙেনখিন, চা থূয়া, চারেও, চালিও এরকম অনেক জটিল পর্বের ভেতর দিয়ে সম্পন্ন হয় একটি মৌসুমের জুম আবাদ। ¤্রাে সমাজ ঐতিহাসিকভাবে জুমচাষের উপর নির্ভরশীল। কেবল মৌখিক নয়, ম্রোদের জুমচাষের ঐতিহাসিকতা নিয়ে অনেক মূদ্রিত বিবরণও আছে। ‘আরণ্য জনপদে’ বইটিতে সাত্তার (১৯৬৬) ম্রোদের জুম সম্পর্কে বলতে যেয়ে লিখেছেন, মুরুংরা কৃষিজীবী হলেও হল কর্ষণের রীতি তাদের ভেতর অনুপস্থিত। জুম চাষের উপরই তারা নির্ভরশীল। সেন্ডেল ও অন্যান্যদের (২০০১) লেখা একটি বইয়ের ১৭ নং পৃষ্ঠায় ক্লস ডায়াটার ব্রাউনস এর ১৯৭১ সালে তোলা একজন ম্রো নারীর জুমধান কাটার রঙীন আলোকচিত্র আছে। জানা যায় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৬০০০ স্লাইড আলোকচিত্র তুলেছিলেন। জুমের ওপর নির্ভর হলেও ¤্রাে জুমভূমি বছর বছর কমছে নানা উন্নয়ন-বাহাদুরিতে। ২০০০ সন থেকে যুক্ত হয়েছে পর্যটন বাণিজ্য। প্রতিবছর যে দেশে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে সেখানে ¤্রাে জুমজমিনের হিসাব আছে কীনা কেন জানে? ম্যারিয়টের মতো বহিরাগত প্রকল্পগুলি কখনোই স্থানীয় নজির ও মায়াময় সম্পর্ককে বিবেচনায় নেয় না। তাহলে কী বিনোদনের কারণে চিম্বুকে হারিয়ে যাবে কৃষি জমি? রুদ্ধ হবে শস্যফসলের বৈচিত্র্যময় উৎপাদন? জাতীয় খাদ্যভান্ডারে কী এর কোনো প্রভাব পড়বে না? জুম হারালে কী কেবল উৎপাদন হারায়? হারায় জিনসম্পদ, জীবন, ভাষা, পরিচয়, হদিশ। রাইচা, রাইরিক, রাইস্যু, রাইজো, নাইংসা, জাম্মা ধানের জাত গুলো কী কেবল একটা বিনোদনপার্কের জন্য হারিয়ে যেতে পারে?

কুয়াইয়েঙ ডাকবে কোথায়?

তখন চিম্বুকের ম্রোদের মন ভাল নেই। রুমা, থানচি এলাকার পাহাড় জুড়ে বাঁশ গাছে ফুল ও ফল ধরেছে। মড়ক লেগেছে বাঁশ ঝাড়ে। এমপু পাড়ার প্রবীণ ম্রো নারী সেকরে ম্রো জানান, এমন হলে দুর্যোগ নেমে আসে পাহাড়ে। ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়, জুম ফসল ঘরে তোলা যায় না। উৎপাদন কমে যায় বলে খন (দুর্ভিক্ষ) দেখা দেয়। একেতো বাঁশ গাছের মড়ক আরেকদিকে কুয়াইঙেন্(ঝিঁঝিঁ) পোকারাও ডাকতে দেরি করছিল। নাংক্লেং ম্রো, ইয়ারম্যান ম্রো, ইয়াংরুং ম্রোদের ভাষ্য, পাহাড়ে পোকাদের ডাকের ভেতর দিয়েই ম্রোরা বুঝতে পারেন কোন্ ঋতু এসেছে। এক এক পোকার ডাক মানে এক এক ঋতু। এপ্রিল-মে এই দুই মাস পাহাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে মূলত; দিনের বেলায়। ম্রোরা বুঝতে পারেন প্রাতলা মাস এসেছে। আর এই মাসেই জুমে বীজ বোনার সময়। ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক বন্ধ হলে আর বীজ বোনা যায় না জুমের পাহাড়ে পাহাড়ে। পাহাড়ে লাইক্লাং পোকা ডাকতে শুরু করলে ম্রোরা বুঝতে পারেন কাটার সময় চলে এসেছে। নভেম্বর থেকে ফেব্র“য়ারি পর্য়ন্ত ডাকতে থাকে তংথের পোকা, মাটির ভেতর থাকা এই পোকারা রাতের বেলায় ডাকে আর ওইসময় চামরামএ্যাত নামের পোকারা ডাকে দিনের বেলায়। কাইসং ম্রো জানিয়েছিলেন, বর্তমানে পোকাদের ডাকাডাকিতেও পরিবর্তন এসেছে, এক ঋতু পেড়িয়ে অন্য মাস এলেও দেখা যায় পোকারা ডাকতে শুরু করেনি। পাহাড়ের প্রকৃতিতে এই পরিবর্তনগুলো প্রবীণজনের জীবনে একেবারেই নতুন। বনউজাড়, বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট, অবকাঠামো আর বহিরাগতের চাপে এমন ঘটছে বলে জানান তখন অনেকেই। হয়তো একটা হোটেল হবে, বিনোদনকেন্দ্র। হয়তো উচ্ছেদ হবে কিছু মানুষের আদিবসতি। কিন্তু কেবল মানুষ তো নয়, এই পাহাড় জুড়ে রয়েছে ঝিঁঝি পোকা, সাপ, কচ্ছপ, পাখি, গুল্মলতা কী নানা বন্যপ্রাণ। মানুষের একতরফা বিনোদনের কারণে বন্যপ্রাণের বসতও চুরমার হয়, তৈরি হয় নানা বিশৃংখলা। আর এই বিশৃংখলা সামাল দেয়া কত দু:সাধ্য তা এই করোনাকালে দুনিয়াময় আমরা টের পাচ্ছি।

বাজুক প্লুং

ম্রোদের ঐতিহ্যগত একটি বাঁশীর নাম প্লুং। ম্রো জনগণ ঐতিহাসিকভাবেই উপস্থাপন রাজনীতির তীব্র নিশানা। তাই সবকিছু আড়াল করে বাহারি প্লুং, গো-হত্যা উৎসব (!), নগ্নতা (!), ম্রো বাহিনী এভাবেই বারবার ম্রো আখ্যান উপস্থাপিত হয় অধিপতি মাধ্যমে। ২০০৪ সনে ¤্রােরা যখন চিম্বুকে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনে নেমেছিলেন তখনো গর্জে ওঠেছিল এই বাহরি প্লুং। ৮ নভেম্বর যখন চিম্বুকে ¤্রােরা প্লুং নিয়ে রাস্তায় নামেন এই প্লুংয়ের সুর আবারো গর্জে ওঠেছিল। বদলে দিয়েছিল চারধার। একদিন এই পাহাড়ে বুক টানটান করে দাঁড়িয়েছিলেন মেনলে ¤্রাে। বলেছিলেন, আং ক্রামাদি। আমি প্রেরিত পুরুষ। মনে পড়ে, একদিন তেংপ্লংচ্যুত পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে আমরা জুম থেকে গ্রামে ফিরছিলাম। যাত্রাপথে ম্রো নারীদের আলাপসালাপ আমার কাছে উন্মুক্ত করেছিল প্রতিবেশবিজ্ঞানের এক জটিল দ

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!