বিশেষ প্রতিনিধি::
বালাট সাবসেক্টরের ডলুড়া-মঙ্গলকাটা এলাকায় ছিল মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিজেদের গুটাতে প্রস্তুতি নেয় হানাদার বাহিনী। তবে এর আগে মড়ণ কামড় দিতে তারাও শক্ত প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ২৭ নভেম্বর হানাদার বাহিনী মঙ্গলকাটা এলাকায় ভয়াবহ আক্রমণ চালায়। আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা অবস্থান ছেড়ে গোদিরগাঁও, নৈদেরখামার ও মীরেরচর এলাকায় অবস্থান নেন। সেখান থেকেই প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এসময় মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তালেব উদ্দিন আহমদ, কৃপেন্দ্র দাস ও চম্পক বাড়ই নামে তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে হানাদার বাহনী। তখনই শুরু হয় নির্যাতন। নির্যাতন করতে করতে সুনামগঞ্জ শহরের পিটিআই টর্চারসেলে নিয়ে আসা হয় তাদের। রক্তাক্ত নিথর দেহ। আঘাত থামছেনা।
২৬ নভেম্বর বিকেলে শান্তি কমিটির আহ্বানে জুবিলী স্কুল মাঠে সভার প্রচার চালানো হয়। পরদিন প্রদর্শন করা হয় তালেব আহমদসগ সম্মুখযুদ্ধ থেকে ধরে আনা তিন যোদ্ধাকে। সভায় হানাদার মেজর সরোয়ার খান ভাষণ দিবেন এ কথাও উল্লেখ করা হয়। ২৭ নভেম্বর বিকেলে জিপ নিয়ে সভাস্থলে ডুকে হানাদার অতিথি। নারায়ে ততবির আল্লাহু আকবর বলে তাকে স্বাগত জানান শান্তি কমিটির নেতারা। বক্তব্য শুরু হলো। এক খান সেনার অনুচর শান্তি কমিটির নেতা মাইকে ঘোষণা দিল ‘৩ জন দুষ্কৃতিকারী (বীর মুক্তিযোদ্ধা তালেব, কৃপেন্দ্র ও চম্পক বাড়ই) ধরা পড়েছে। সভা তড়িঘড়ি করে শেষ করে ৪ জন মিলিশিয়া তালেবসহ ৩ জনকে নিয়ে হাটতে শুরু করলো। বেড়ে চলছে নির্যাতন। মিলিশিয়াদের পাশাপাশি দালালরাও নির্যাতন করছে। খুড়িয়ে হাটছেন তিন যোদ্ধা। মিলিশিয়ারা বাঁশের লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছিল। মিলিশিয়া আর দালালরা বার বার বলছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বল শালা। ৩ জনেরই মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ গর্জে ওঠলেন তালেব। মৃত্যুভয় ওড়িয়ে তার উচ্চকণ্ঠে ধ্বনিত হলো অবিনাশী স্লোগান, ‘জয় বাংলা’। সেই ঘোষণা প্রতিধ্বনিত হলো চারপাশে। তারপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে চলে। এসময় দালাল রহমান মিয়াসহ পাকিস্তানপন্থীরা তাদেরকে নির্যাতন করে। সন্ধ্যায় তাদেরকে পিটিআই টর্চারসেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের নইদের খামার এলাকায় হানাদার বাহিনীর হাতে তালেব আহমদ, পাগলা শত্রুমর্দন এলাকার কৃপেন্দ্র কুমার দাস ও সিলেট জৈন্তাপুর খান টি ষ্টেট এর চা বাগানের শ্রমিক চম্পক বাড়ইকে ৫ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত টর্চার সেলে রেখে নির্যাতন করা হয়। ৬ই ডিসেম্বর ভোরে সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবসের দিন হানাদাররা আহসানমারা সেতুর পাশে রশি দিয়ে বেধে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে পুরান সুরমা নদীতে ফেলে চলে যায়। কয়েকদিন পরে তাদের মৃতদেহ ভেসে ওঠলে স্থানীয়রা সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেন। পরে বালাট সাবসেক্টরের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলফাত উদ্দিন মোক্তারসহ মুক্তিযোদ্ধা জনতা তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জয়কলস উজানীগাও উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গণকবর দেন। তিন ধর্মের তিন যোদ্ধা একই কবরে ঘুমিয়ে একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন এখনো।