1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৪ অপরাহ্ন

সুনামগঞ্জের নিশ্চিহ্ন ১০টি গণহত্যাস্থল: আজও নির্মিত হয়নি স্মৃতিস্মারক

  • আপডেট টাইম :: বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১.১০ এএম
  • ৩০৪ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি::
১৯৭১ সনে সুনামগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায় গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। নীরিহ মানুষকে হত্যা করেছিল খান সেনা ও রাজাকাররা। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও সেইসব গণহত্যাস্থলের স্মৃতিচিহ্ন মুছে গেছে। কয়েকটি গণহত্যা নিয়ে হাওরটুয়েন্টিফোরের বিশেষ বিজয় আয়োজন।
শনির হাওরে গণহত্যা:
১৯৭১ সনের ১৫ সেপ্টেম্বর হানাদার বাহিনী তাহিরপুর সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়েছিল। এক পর্যায়ে টেকেরঘাট সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে এসে তাহিরপুর সদরে নারকীয়তায় মেতে ওঠে। এ সময় হাওর পাড়ি দিয়ে নৌকাযোগে তাহিরপুর সদরের বাড়িতে আসছিলেন ৭ জন নীরিহ মানুষ। তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। একদিন তাদের ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন করে। পরে সবাইকে রশি দিয়ে বেধে শনির হাওরে নিয়ে যায়। নৌকার সামনে তাদের ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে।
কৃষ্ণতলা গণহত্যা:
শ্রাবণ মাসে হাওরাঞ্চলের কুখ্যাত দালাল জামালগঞ্জের লক্ষীপুরের লাল মিয়া নরসিংদী এলাকার ১৩ জন যুবককে ধরে এনেছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারত সীমান্তে আসার জন্য জামালগঞ্জ হয়ে রওয়ানা দিয়েছিলো বলে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। হালির হাওর থেকে তাদের আটক করা হয়। তাদের গ্রেপ্তার করে দালাল লাল মিয়া তার নিজস্ব লঞ্চযোগে সুনামগঞ্জ নিয়ে আসে। এই যুবকদেরকে দ্বিতীয় দফা সুনামগঞ্জের পিটিআই টর্চারসেলে নির্যাতন করা হয়। পরে তাদেরকে সুরমা নদীর উত্তরপাড়ের কৃষ্ণতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে হানাদারদের শক্তিশালী ক্যাম্প ও নির্যাতন সেল ছিল। এখানেই তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
শ্রীপুর গণহত্যা:
সুনামগঞ্জ জেলার পা-ারগাও ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে একাত্তরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল হানাদার বাহিনী। এই গ্রামটি মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্নভাবে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতেন। যে কারণে ক্ষুব্দ ছিল হানাদার ও রাজাকাররা। গ্রামবাসীও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। ছাতক থেকে নৌকা যোগে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একাত্তরের ১৪ নভেম্বর এসে শ্রীপুর গ্রামে পৌঁছে। ১৪ নভেম্বরই এই গ্রামে গণহত্যা চালায় তারা। গ্রামে নির্বিচারে হত্যা করে আগুনে পুড়িয়ে দেয় বসতঘর গুলো। শ্রীপুর গ্রামে ডুকে প্রথমে হিন্দু পরিবারগুলোতে হানা দেয়। ধরে আনে নারীদের। বিভিন্ন ঘরে ডুকে নারীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে নির্যাতন শুরু করে।
ভাদেরটেক গণহত্যা
সুনামগঞ্জ শহরতলির গ্রাম বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ভাদেরটেক। ৯ সেপ্টেম্বর হানাদার বাহিনী হঠাৎ সংঘবদ্ধ আক্রমণ করে ভাদেরটেক গ্রামে। দুইদিক থেকে ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছিল গ্রামটিতে। এলোপাথারি মর্টার নিক্ষেপ করে গ্রামটি লক্ষ্য করে। একই সঙ্গে মেশিনগানের বেশুমার গুলিও ছুড়ে। এসময় হানাদার বাহিনী গ্রামে ডুকে নীরিহ মহিলাদের সম্ভ্রম লুণ্ঠনে মেতে ওঠে। রাজাকাররা লুট করে নিয়ে যায় সম্পদ।
ভাদেরটেক গণহত্যায় হানাদারদের গুলিতে শহিদ হন কয়েকজন নীরিহ মানুষ।
শ্যমারচর-পেরুয়া গণহত্যা:
১৯৭১ সনের ৪ ডিসেম্বর। সেদিন ছিল অগ্রহায়ণ মাসের ১৭ তারিখ। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামারচর-পেরুয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শীর্ণকায় সুরমা নদীর (পুরান সুরমা) পানি ছিল অনেকটা ঘোলা। ১০-১২টি গ্রামে তা-বলীলা চালিয়েছিল সত্তরের নির্বাচনে পিডিপির পরাজিত প্রার্থী দৌলতপুর গ্রামের দালাল আব্দুল খালেকের প্রশিক্ষিত রাজাকার বাহিনী। পেরুয়া গ্রামের শতাধিক মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। বাজারের পূর্ব-উত্তর পাশে সুরমা নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছিল ২৬ জনকে। পরে গ্রামে ডুকে নির্বিচারে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও লুন্ঠন শেষে পুরো গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। নিহত-আহতদের রক্তে লাল হয়ে যায় সুরমার ঘোলা পানি। লাইনে দাড়ানোর পরও মাথার উপর দিয়ে গুলি চলে যাওয়ায় বেঁচে যান কিশোর শৈলেন রায় ও হীরেন্দ্র শেখর রায় সেন্টু নামের দুই ভাই। সম্প্রতি করোনায় মারা গেছেন সেদিন বেঁচে যাওয়া শৈলেন রায়। এ গণহত্যায় তাদের পরিবারের ৬ জন শহিদ হন। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও এই গণহত্যাস্থল অরক্ষিত। কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই। এলাকাবাসী গণহত্যাস্থলে শহিদের স্মরণে স্মৃতিস্মারক নির্মাণের দাবিতে জেলা প্রশাসকসহ সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন করেছেন।
উজানগাঁও গণহত্যা:
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভোর থেকেই নারকীয় হত্যাযঞ্জে মেতে ওঠে রাজাকার আব্দুল খালেক বাহিনী। সে দৌলতপুর গ্রামের পাশের গ্রাম উজানগাও গ্রামেও গণহত্যা চালানোর মাধ্যমে নারকীয়তা শুরু করে। গ্রামের ৩৫টি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সাতজনকে হত্যা করে। ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় পিয়ারা বেগম, মুক্তাবান বিবি, জমিলাসহ কয়েকজন তরুণীকে। তাদেরকে পাশের জঙ্গলে, ক্যাম্পে রেখে কয়েকদিন অমানুসিক নির্যাতন করে। একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর দালাল খালেক, ডাক্তার সোবান, এলিম উদ্দিন, মুকিত মনিরসহ দালাল-রাজাকারদের হাতে শহিদ হন উজানগাও গ্রামের মামুদ আলী, মাখন মিয়া, বোছন আলী, আজিদ ফকির, আপ্তর মিয়া, ইদ্রিস আলী, আতিব উল্লাহ। এরা ছিলেন একই পরিবারের আতœীয়-স্বজন।
মোহনপুর গণহত্যা:
আনাই মিয়া, আব্দুর রজাক, রফিক মিয়া, রউফ মিয়া ও সাইদ মিয়া এরা মোহনপুর ইউনিয়নের মোড়ারবন্দ নৌকাখালির দালাল ছিল। পিডিপির এই নেতারা একাত্তরে জল্লাদে পরিণত হয়েছিলো। রাজাকার ও শান্তি বাহিনীতে নাম লিখিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হত্যা করতো। বাড়িঘর লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করতো।
মোহনপুর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামের ভিতর প্রবাহিত দুটি খাল দিয়ে একাত্তরে জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন সুরমা নদী হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী হতেন। মোহনপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সাখাদ আলী, আফিল মিয়া, কালা ময়না, ফরিদ মিয়া, সমির উদ্দিনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নিরাপদে সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে তাদেরকে সীমান্তে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেন। এতে ক্ষুব্দ হয়ে উঠে মুড়ারবন্দ গ্রামের আব্দুর রজাক, আনাই মিয়া, রফিক মিয়াসহ কয়েকজন। এরা সবাই ছিল উগ্র পিডিবি কর্মী। প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হলেই সরাসারি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তারা। শরণার্থীদের নৌকায় হানা দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিতো। রফিকুল বারী মিয়া জোর করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক তরুণিকে তুলে এনে ধর্মান্তরিত করে বিয়েও করেছিল। তারা মোহনপুর গ্রামের কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে ধরে নিয়ে হাত পা বেধে পানিতে ফেলে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তেঘরিয়া গণহত্যা:
১৯৭১ সনের ১১ মে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামের বয়স্ক মানুষজন এ দিনটি ঘুরেফিরে এলে ভয়ে কুকড়ে যান। ওইদিন স্থানীয় উজানীগাঁওয়ের সাত্তার রাজাকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গ্রামে নিয়ে এসে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ শেষে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন গ্রামের নীরহ সাতজন মানুষ। স্বাধীনতার পরে রাজাকার কমা-ার আব্দুস সাত্তারের বিরুদ্ধে প্রায় দুই শতাধিক মামলা দায়ের হয়েছিল।
কামারগাও গণহত্যা:
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার দুর্গম গ্রাম কামারগাও। গ্রামের অন্তত ৩০ জন যুবক একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা চালানোর কাজ করতেন। গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানের জন্য দান করেছিলেন ৫টি নৌকা। গ্রামের নারীরা রেঁধে খাইয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালাতে এসে এখানে বিশ্রাম নিতেন মুক্তিযোদ্ধারা। হাওরাঞ্চলের শ্রেষ্ট রাজাকার আলী রেজার নির্দেশে বিজয়ের তিনদিন আগে এক সকালে অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয় গ্রামবাসীর উপর। হাওরঘেরা গ্রামটির তিনদিক দিয়ে অতর্কিত হামলা চালায় রাজাকার বাহিনী। গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গ্রাম বাছাই করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ২০ জন নারীকে। রাজাকার বাহিনীর গুলিতে ওইদিন শহিদ হন ৫ জন নিরীহ নারী পুরুষ।
ডুংরিয়া গণহত্যা:
একাত্তরের ২৮ আগস্ট দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ডুংরিয়া গ্রামে হানাদার বাহিনী উজানীগাও গ্রামের জল্লাদ আব্দুস সাত্তারকে সঙ্গে নিয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল। ৫০টির অধিক নৌকাযোগে হাওর-খাল বেষ্টিত গ্রামটিতে হামলা করেছিল রাজাকার-মিলিশিয়ারা। এই নৌকা গুলো সরবরাহ করেছিল উজানীগাও গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আব্দুস সাত্তার। ওইদিন তারা হত্যা করেছিল গ্রামের নিরীহ ৮জনকে। প্রথমে ডুংরিয়ার শিবপুর ছাকলপাড়া মহল্লায় কাছা মিয়ার বাড়িতে ৩০ জন মানুষকে জড়ো করে হানাদার বাহিনী। তাদের উপর চরম নির্যাতন চালায়। তিরিশজনের মধ্যে বাছাই করে কয়েকজনকে লাইনে দাড় করিয়ে রাইফেল দিয়ে গুলি চালিয়েছিল।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!