আমাদের আইকন। বড়ো গর্বগৌরবের, চিরকালের নায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা—কবীর চৌধুরী। এ নামেই চিকিৎসাজগতে পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নামটি মো. উবায়দুল কবীর চৌধুরী। সুনামগঞ্জ দিরাই উপজেলা ভাটিপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া মানুষটি পরিব্যাপ্ত হয়েছেন বিশ্বনাগরিকে। ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পদকে। এই কৃতবিদ্য বিখ্যাত ব্যক্তির আজ ৭০তম জন্মদিন। একাত্তরের এই বীরযোদ্ধার জীবনালোচনা, কর্মমূল্যায়ন, সংগ্রাম এবং স্বদেশ হিতৈষণা নিয়ে তাঁর একাত্তরতম জন্মদিনে আমরা একটা সংবর্ধনগ্রন্থ প্রকাশ করবো— এমনই প্রত্যাশা করি।
আজ শ্রদ্ধানিবেদনসূত্রে তাঁর জীবনালেখ্যের কিছুকথা এখানে সামান্য বাক্যের আয়োজনে ধরার চেষ্টা করব।
তাঁর খ্যাতিকীর্তি বিশ্বব্যাপী হলেও স্বভাবে নিভৃতচারী—ফলে নতুন প্রজন্ম তাঁকে চেনে না।
পড়াশোনা করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি, গ্লাসগো রয়েল কলেজ, আমেরিকা কলেজ অব এনজিওলজি, লন্ডন সেন্টথমাস হসপিটাল, আমেরিকার হার্ভার্ড মেডিক্যালে। এছাড়াও দিল্লির এইমস থেকে স্কিন সার্জারিসহ স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কানাডার অটোয়া ইউনিভার্সিটি, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপি মেডিক্যাল সেন্টার এবং কলকাতার রিতা স্কিন ফাউন্ডেশনে ভিজিটিং অধ্যাপক হিশেবে বিভিন্ন সময়ে পাঠদান করেন। বর্তমানে তিনি এম এইচ শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও উপদেষ্টা হিশেবে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভিজিটিং প্রফেসর হিশেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিশেবে নিয়োজিত আছেন।
কবীর চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র চিকিৎসক যিনি কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিশেবে ২০০৩ সালে যোগদান করেন। একই সঙ্গে সারা বিশ্বে বিভিন্ন চর্মরোগ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বশেষ উন্নয়ন এবং গবেষণামূলক বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন।চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে তাঁর লেখা কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থও রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদান তাঁর মহত্তম অবদান। যুদ্ধ চলাকালে ছিল তাঁর সাহসী এবং সেবামূলক ভূমিকা। এর জন্যই যেন প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর ছিল একটা সাহসী সত্তা। বাবা গোলাম কাদীর চৌধুরী ছিলেন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। অগ্রজেরা ছিলেন সংগ্রামী ছাত্রনেতা।
চাচাতভাই আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন তাঁর সময়ের একজন প্রাগ্রসর চিন্তার মানুষ। পেশায় আইনজীবী হলেও বিত্তি হিশেবে নেননি। গ্রামের শ্যামল পরিবেশেই থাকতে পছন্দ করতেন।
ছাত্ররাজনীতিতে ছিল তাঁর ঐতিহাসিক অংশগ্রহণ। তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জ কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি এবং সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর ১৯৬৩ সালের ২২ ও ২৩ জুলাই সুনামগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ এক কর্মীসম্মেলন। ঢাকা ও সিলেট থেকে বহু নেতাকর্মী যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেন।
জগন্নাথ কলেজে পড়াকালীন করীব চৌধুরী সরাসরি ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর অগ্রজ ফজলুল কাদীর চৌধুরী তদানীন্তন কায়েদে আজম কলেজে ছাত্রলীগ থেকে সংসদের সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। করীব চৌধুরী ১৯৬৮ সালে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি এবং প্রত্যেকটি দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। ৬৯ এর গণআন্দোলনে শরিক হন। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে। এরই প্রতিবাদে তিনি ফজলুল হক হলের ছাত্রদের নিয়ে শহিদমিনারে রাত দুইটায় সভায় মিলিত হন। পরে লাশ মর্গে নিয়ে আসেন এবং আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন।
বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যখন শহিদমিনারে আসেন, তখন তিনিও নিয়মিত সংগ্রামী হিশেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে মেডিক্যালের ছাত্র হিশেবে জননেতা আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে সুনামগঞ্জ সফর করেন। ভাটিপাড়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। তাঁর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। তিনি সংগঠনের কাজে গ্রামে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেখানেই ছুটে আসেন ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র আহ্বান শুনে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি ঢাকায় ছিলেন।স্বাধীনতার ডাক শোনেন সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রেসকোর্স ময়দানে। ফলে বীরযোদ্ধা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর সময় লাগেনি। তিনি ভাটিপাড়া চলে আসেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার ঘটনা শোনার পর তিনি ২৬ মার্চ গ্রামবাসীদের নিতে প্রতিবাদ মিছিল ও সভা করেন। একই গ্রামের আবদুল মজিদ চৌধুরী মানিক মিয়ার নেতৃত্বে তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং ভাটিপাড়া হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করেন। কবীর চৌধুরী তাঁর পিতার বন্দুকটি সঙ্গে নিয়ে অবরুদ্ধ গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেন। চালিয়ে যান চিকিৎসাসেবাও।
এক ঝড়-জলের দিনের কথা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভাটিপাড়া ইউনিয়নসংলগ্ন বাইবনা নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে। এর আগে ইউনিয়নে প্রবেশের জন্য হানাদার বাহিনী অপারেশনে সফল হয়নি। কিন্তু ওই ঝড়-জলের সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশ আলী শহিদ এবং কয়েকজন আহত হন। কবীর চৌধুরী সহযোদ্ধা আরশ আলীর লাশ উদ্ধার করে সাতজন গ্রামবাসী নিয়ে সমাহিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর মানবসেবার ব্রত এবং স্বদেশ প্রেমের মন্ত্র নিয়ে শুরু হয় তাঁর আদর্শিক জীবনের পথচলা। শিক্ষার সমুদ্র পার হয়ে কর্মের সায়রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অর্জন করেন খ্যাতিকীর্তি। তাঁর সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। ইতোমধ্যে তিনি সম্মান স্বীকৃতি এবং নানান উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন।
কিন্তু চিকিৎসাজগতের শিখরে বিচরণ করলেও, আর্থিক দিক থেকে আটপৌরে মধ্যবিত্তই থেকে যান। বিনে পয়সার রোগীর সংখ্যাই তাঁর বেশি। এলাকায় তিনি গরিবের ডাক্তার বলেই পরিচিত। তিনি অসহায় রোগীদের এম এইচ শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। তাঁর কাছে গিয়ে বিনা পয়সায় সেবা পেয়ে খুশি দরিদ্র মানুষ। মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
তাঁর ধর্মপ্রাণতা ও শিক্ষাপ্রীতিরও পরিচয় দিয়েছেন। নীরবে নিঃস্বার্থ দানস্পৃহা তাঁকে করে তুলেছে অনন্য মানুষ মহান।সাধ্যমতো এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুলে অনুদান এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। ভাটিপাড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং পোস্ট অফিসের জন্য জায়গা কিনে সরকারকে দান করেছেন। তিনি ‘বৃক্ষমানব খ্যাত আবুল বাজানদার’সহ অন্য অনেকের জটিলরোগের সফল চিকিৎসা করে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন। এবং ওই রোগীকে জমি দান করে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করেন।
তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন ঘাতকচক্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। তিনি তখন ঢাকা মেডিক্যালে ইন্টার্নি ডাক্তার হিশেবে দায়িত্বরত। আহত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বোন এবং দুই ভাগনি জরুরি চিকিৎসা নিতে আসেন। একটু পরই ঘাতক মেজর নূর গালি দিতে দিতে হাসপাতালে আসে। আহত সহযোগীকে দেখতে। এমন সময়ে কবীর চৌধুরী দারোয়ানকে দিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দেন। এবং তাঁদের বাঁচাতে সহযোগিতা করেন। ওয়ান ইলেভেনেও শেখ হাসিনাকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠীর রুষ্ট আচরণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল এই বীর চিকিৎসকের।
সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলা অন্তর্গত ভাটিপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম ১৯৫১ সালে। তিনি এক পুত্র ও দুই কন্যার জনক। তাঁর জ্যৈষ্ঠ কন্যা মেহনাজ কবীর একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ।
কবীর চৌধুরীর যা কিছু অর্জন, তাঁকে আরও মহৎ, আরও বিনয়ী এবং সেবাব্রতী করেছে। এই মহান ব্যক্তির জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং ভালোবাসা।