1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৫ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

মুখ ঢাকা মহামারি ।। পাভেল পার্থ

  • আপডেট টাইম :: বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭.৩৫ পিএম
  • ২৮২ বার পড়া হয়েছে

কত কিছুতে কত কারণে যে মুখ ঢাকে মানুষ। সময়ে-অসময়ে, সামনে কী পিছনে। শংখ ঘোষের ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। ‘দস্যুবনহুর’ সিনেমায় আজাদ রহমান গেয়েছেন, ‘..মুখঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায় মানুষকে কি দেখে চিনবে বলো?’ মানুষ কেন মুখ ঢাকে? এই আলাপ না হয় আরেকদিন হবে। কিন্তু নিদারুণভাবে আজ আমরা সবাই মুখ ঢেকে আছি। গ্রাম থেকে শহর, বন্দর থেকে বাজার। এর আগে পৃথিবীর এতো মানুষ হয়তো একসাথে মুখ ঢেকে পাড়ি দেয়নি মাসের পর মাস। দিনের পর দিন। মানুষ বলতে মানুষের ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ প্রজাতি। ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপের ‘হবিট’ মানুষেরা কী তাদের সময়ে কখনো সবাই মুখ ঢেকে ছিল? ‘হোমো হ্যাবিলিস’, ‘হোমো ইরেকটাস’ বা ‘নিয়ানডার্থাল’ প্রজাতির মানুষেরাওতো দীর্ঘদিন পৃথিবীতে টিকে ছিল। গড়ে তুলেছিল নিজেদের সভ্যতা। সেইসব মানুষদের কী এমন কোনো দু:সময় এসেছিল করোনা মহামারির মতো? একসাথে মুখ ঢেকে থাকতে হয়েছিল সবাইকে। বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি যতটুকু খুঁজেছি এই জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর পাইনি। হয়তো বিজ্ঞানী, গবেষক ও একাডেমিকরা এর উত্তর দিতে পারবেন। যাহোক আমি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার প্রবীণ নারী-পুরুষের সাথে করোনাকালে কথা বলেছি। ‘মহামারির স্মৃতি-বিস্মৃতি’ বিষয়ক গবেষণার কাজে তাদের অনেকের সাথে কয়েকদিন ধরে আলাপক করতে হয়েছে। ৮০ থেকে ১২০ বছর তাদের বয়সের ভাগ। তাদের অধিকাংশই জীবনে তিনটি মহামারি দেখেছেন। কলেরা, গুটিবসন্ত এবং করোনা। যদিও এইসব ‘মহামারি’ বিদ্যায়তনে ‘প্যানডেমিক’, ‘এনডেমিক’ কী ‘সিনডেমিক’ নানাভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। কিন্তু তারা ঘরের পর ঘর, পাড়ার পর পাড়া, গ্রামের পর গ্রাম সংক্রমিত হতে দেখেছেন। একের পর এক মানুষ মরতে দেখেছেন। সঙ্গনিরোধ, লকডাউন, নিরাপদ দূরত্ব, লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি তারাও মান্য করেছেন। এই প্রবীণেরা নিজেদের দাদু-নানি কিংবা মা-বাবাদের কাছ থেকেও প্রাচীন মহামারি বিষয়ে শুনেছেন। কিন্তু এই প্রথম করোনাকালে কোনো মহামারির অভিজ্ঞতা তাদের হলো, যা, এর আগে কখনো হয়নি। এই ‘মুখ ঢেকে রাখা মহামারি’। মাস্কে মুখ ঢেকে ঢেকে দুনিয়া প্রায় একটি বছর পাড়ি দিল। এই মুখ ঢাকা মহামারিতে তৈরি হওয়া কিছু অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা নিয়েই এই বছর শেষের আলাপ। আসছে নতুন বছর কেমন হবে? এক মহামারিকালে একটি বছর থেকে আরেক বছর কী নয়া কোনো বার্তা জানাবে? পৃথিবীর সব অস্ত্র কারখানা গুলো কী ঘুমিয়ে পড়বে? পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠবে কি বীজঘর বা পাঠাগার? পুরুষতন্ত্রের পিরামিড কী চুরমার হয়ে যাবে? বিলাসবহুল হোটেল নয়; চিম্বুক পাহাড়ে গরিবের হাসপাতাল কিংবা বিদ্যালয় তৈরি করবে কি ম্যারিয়ট?
মহামারি দাগ রেখে যায়
সব অসুখ কী বিপদ কোনো না কোনো দাগ রেখে যায়। দখলের পর নদী যেমন রেখে যায় শীর্ণ জলরেখা। টুপ করে বনতলে পড়ার আগে ডুমুর যেমন গাছে রেখে যায় বোঁটার দাগ। এমনি কত কত দাগ থাকে মানুষের। মনের অতল থেকে শরীরময়। স্মৃতি কী বিস্মৃতির ময়দানে। বরেন্দ্রর কৃষক ইউসুফ মোল্লা ১৩৬৪ বাংলায় ৮/৯ বছরের এক ছোট্ট শিশু। রাজশাহীর তানোরের দুবইল গ্রাম থেকে চাপাইনবাবগঞ্জের দারিয়াপুরে বিয়ে করতে গিয়েছিল তার এক ফুফাত ভাই। সেই ভাইয়ের ভাগিনা ভেলু বরযাত্রায় গিয়ে দুবইলে বসন্ত নিয়ে আসে। ছড়িয়ে পড়ে বসন্ত। জোড়ায় জোড়ায় মরে মানুষ। ইউসুফের ফুফু খুকি বেওয়ার শরীর থেকে মাংশ খসে খড়ে পড়েছিল। শরীরজুড়ে মহামারির দাগ নিয়ে বেঁচেছিলেন তিনি। করোনা মহামারি কী দাগ রাখছে আমাদের মন ও শরীরে? মৃত্যু এক নিদারুণ দু:সহ স্মৃতি-বিস্মৃতির দাগ। আবার আক্রান্তদের অনেকের করোনা-উত্তর নানা শারিরীক জটিলতাও দেখা দিচ্ছে। শরীর জুড়ে থাকছে সংক্রমণের জটিল দাগ। করোনাকালে কাজ হারানো, ঘর হারানো, বসতি হারানো, স্বজন হারানো মানুষের মনে কত যন্ত্রণার দাগ। কলংক নয়, অপবাদ আর গুজবের দাগও উসকে ওঠেছে করোনাকালে। দু:সহসব জটিল যন্ত্রণার দাগ নিয়েই করোনাকালে শুরু হচ্ছে আরেকটি নতুন বছর। ২০২১ সন আমাদের জন্য কেমন দাগের বহর নিয়ে অপেক্ষা করছে? দাগের আঘাত সইবার মতো প্রস্তুতি কী নিয়েছি আমরা? দাগের যন্ত্রণা সইবার মতো কী একত্র হয়েছি সকলে? তাহলে করোনাকাল এই দশ মাসে আমাদের মনে কী কোনো বার্তা তৈরি করেনি?
কৃষকের সম্মান
দেশ দুনিয়া লকডাউন হলেও নির্ঘুম কৃষকসমাজ আমাদের সামনে হাজির করেছে ভাতের থালা। মুখ না ঢেকেই তরতাজা রাখতে হচ্ছে কৃষির দম। করোনা-উত্তর সময়ে কতজন তরুণ কৃষক হতে চাইবে। কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষক হবে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানীয় নাগরিক। ভিআইপি বা সিআইপিদের মতো। ফসল নিয়ে বাজারে গেলে মানুষ কৃষককে আলাদা জায়গা করে দিবে। ন্যায্যমূল্য বিক্রি হবে জানবাজি রাখা ফসল। ব্যাংকে গেলে ম্যানেজার কৃষককে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে বিনাসুদে ঋণ কার্যকর করে দিবেন। কোনো বহুজাতিক কোম্পানি সার-বিষ বা বীজ নিয়ে কৃষকের সাথে কোনো প্রতারণা করার ক্ষমতা পাবে না। করোনার পর স্কুল গুলো আবার খুলবে। শিশুরা লিখবে, বড় হয়ে আমি একজন কৃষক হতে চাই।
লাশের হোটেল হবে পাখি জাদুঘর
করোনাকালে নির্দয়ভাবে খুন ও পাচার হয়েছে বন্যপ্রাণী। সিলেটের হরিপুরে বন্ধ হয়নি পাখিদের লাশের হোটেল। ২০২১ সনে হয়তো এমন অন্যায় কিছুই থাকবে না। খাগড়াছড়ির পানছড়ির জবা ও সমাই সাঁওতালের মতো লাখো মানুষ এতিম ও আহত কোনো সজারুর স্বজন হয়ে যাবে। লালমনিরহাটের তুলসি রানী ও দুলাল চন্দ্র রায়ের মতো জমি বেচে বন্দীদশা থেকে বাঁচাবে কেউ হাতি বা শকুন। নিজের সন্তানের মতো দায়িত্ব নেবে কোনো বন্যপ্রাণীর। আরো পাখিদের জন্য রাজশাহীর খোর্দ্দবাউসার শামুকখোলদের মতো আবাসস্থল ভাড়ার বাজেট বরাদ্দ করবে রাষ্ট্র। হরিপুর বাজারের পাখির লাশের হোটেল গুলো হবে পাখি জাদুঘর। এখানে দেশের হারানো পাখিদের জনস্মৃতি থাকবে, পাখির ফসিল কী বিগত সময়ের পাখি হত্যা ও বিচারের সকল তদন্তপ্রতিদেন।
বনের ব্যক্তিসত্তা
অরণ্য, নদী, পাহাড় কী জলাভূমি কেউ মহামারিকালে রেহাই পায়নি। দখল, দূষণ আর খুনখারাবি হয়েছে নির্মম। বিচারবিভাগ নদীর জীবন্ত ব্যক্তিসত্তা ঘোষণা করলেও নদী কি বইছে অবিরল? উজান থেকে ভাটিতে? মেঘালয়ের লুকা নদী সিমেন্ট ও কয়লা কারখানার বিষে নীল হয়েছে। লুকা থেকে বাংলাদেশের লোভাছড়া কি সারি নদীতে ছড়িয়েছে বিষ। নিরুদ্দেশ হয়েছে চিরিংবিত মাছ (গোয়ালপাড়া লোচ)। পৌরাণিক ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীন তৈরি করছে বৃহৎ বাঁধ। ¤্রােসভ্যতাকে চুরমার করে চিম্বুক পাহাড়ে তৈরি হচ্ছে মার্কিন ম্যারিয়ট হোটেল। মুখ ঢাকা মহামারি যেন আড়াল করছে নাজুক বাস্তুতন্ত্র। ২০২১ সন নিশ্চিতভাবে মর্যাদা ও সাহস নিয়ে দাঁড়াবে। কারণ আমাদের করোনার নির্দয় স্মৃতি ও মহামারির অবিস্মরণীয় শিক্ষা আছে। পাহাড়, অরণ্য, জুম-জমিন এবং নদী ছাড়া বাঁচবে না মানুষ। করোনা-উত্তর সময়ে সকল পাহাড় ও অরণ্য পাবে ব্যক্তিসত্তার অধিকার। চাইলেই একটা বিনোদনকেন্দ্র কী বিচ্ছিরি কোনো স্থাপনা কেউ কোনো বন-পাহাড়ে বসিয়ে দিতে পারবে না। স্থানীয় অধিবাসীদের মতামত ও অনুমতি ছাড়া শুরু হবে না কোনো উদ্যোগ।
ভোগ নয়, সমান ভাগ
করোনাকাল প্রমাণ করেছে লাগাতার ভোগবাদ আর পণ্যমানসকিতা মানুষের সভ্যতাকে শেষ করে দিতে পারে। একটা দামি গাড়ি, খেলার মাঠ গুঁড়িয়ে তোলা লম্বা দালান, কোক-পেপসির ঢকঢক আর নিত্যনতুন বাহারি ব্র্যান্ডের পোশাক না হলে চলে না যে জীবন; সে জীবন ভোগবাদের। এই মানসিকতাই পণ্যমানসিকতা। আর এই ভোগবাদ তরতাজা রাখতে এলোপাথারি কার্বন নির্গমনের জন্য নিদারুণ উষ্ণ হয়ে ওঠছে পৃথিবী। বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা কি খরার প্রকোপ। মানুষ ছাড়ছে গ্রাম, কৃষিকাজ। পরিচয় হারিয়ে শহরে এসে মানুষ হয়ে যাচ্ছে দিনমজুর। দুনিয়া ভাগ হয়ে আছে পঁচাশি আর পনেরোতে। পনেরজন পুরুষ মিলে একতরফাভাবে খন্ডবিখন্ড করছে গ্রহ। আর দুনিয়াকে বাঁচাতে নিরন্ন রক্তাক্ত হয়ে আছে পঁচাশি ভাগ মানুষ। এই বৈষম্যের বিজ্ঞাপন উল্টে দিতে হবে। ২০২১ থেকেই একটা ন্যায্য দুনিয়ার জন্য লড়তে হবে আমাদের। ভোগ নয়, দুনিয়ার সব দু:খ-সুখ সবার সাথে সমান ভাগ করবার কায়দা তৈরি করতে হবে। এটাই হোক নতুন বছর ২০২১ এর দুনিয়া কাঁপানো জনআওয়াজ।
……………………………………….
লেখক ও গবেষক। animistbangla@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!