২০২০সাল সম্পর্কে মনে হয় এক বাক্যে বলা যায় বিশে বিষ!এই সময়ে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পরে গোটা বিশ্বকে এক প্রকার থামিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস।যদিও এর উৎপত্তি ২০১৯এর শেষের দিকে কিন্তু এটি তান্ডব চালিয়েছে ২০২০সালের পুরাটা সময় জুড়ে।এখন থেকে প্রায় ১০২ বছর পূর্বে এভাবেই একটি ফ্লু অচল করে দিয়েছিলো পুরো পৃথিবীকে।হুম,১৯১৮সালের স্পেনিশ ফ্লু সম্পর্কে বলছি।১ম বিশ্ব যুদ্ধে যখন পরাশক্তিগুলো নিজেদের সামরিক শক্তির মহড়া দিচ্ছিলো,তখন স্পেনিশ ফ্লু তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো যে সমারিক শক্তির চেয়েও বড় শক্তি আছে,যা মোকাবিলায় প্রস্তুত ছিলো না কেউই।সেই মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি এমন কোন দেশ মনে হয় পাওয়া যাবেনা।প্রানহানি যখন ৫কোটির অধিক ছাড়িয়ে গিয়েছিলো তখন পরাশক্তিগুলোর কাছে ম্যাসেজ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা যে সব শক্তির বিরোদ্ধে যোদ্ধ করার ক্ষমতা তাদের নেই,তারাও এক পর্যায়ে অসহায়।খোদ যুক্তরাজ্যে প্রায় ২লাখ ২৮হাজার প্রাণহানি হয়েছিলো,সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিলো মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশে।তারপর পেরিয়েছে ১০০ বছরের অধিক সময়।তথ্য-প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি সাধিত হয়েছে চোখে পরার মতো।অতীতের যেকোন সময় থেকে এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান উৎকর্ষ সাধনে শীর্ষে আছে।সামরিক শক্তিতে পরাশক্তিগুলো যে অগ্রগতি লাভ করেছে তা দিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করা যাবে কয়েকবার।উন্নয়ন অগ্রগতিতে ইউরোপ-আমেরিকা আভির্ভূত হয়েছে মডেল হিসেবে।অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সেই মডেল অনুরসরণ করতে অনুপ্রাণিত বা বাধ্য করা হচ্ছে।ব্যাপারটা এমনভাবে ব্র্যান্ডিং হচ্ছে যে আপনি সেই মডেল অনুসরণ না করলে পিছিয়ে যাবেন।সেই মডেল দেখায় ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়া বাকি সবদেশ পিছয়ে পড়া,অনুন্নত বা অসভ্যও বটে! প্রায়শ আমাদের দেশেই শোনা যায় আমরা নাকি ইউরোপ-আমেরিকা থেকে যুগ যুগ পিছিয়ে আছি।অর্থাৎ,তাদের কাতারে যেতে আমাদের অরোও কয়েকযুগ চেষ্টা করতে হবে।মূল কথা হচ্ছে,আমাদের অবশ্যই সেই মডেলের দিকেই হাঁটতে হবে।এডওয়ার্ড সাঈদ সেই মডেল বা ধারণাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন প্রাচ্যবাদ তত্ত্ব দিয়ো।তিনি বলেছেন,এই ধারণা দিয়ে ইউরোপ(বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স)-আমেরিকা(২য় বিশ্ব যুদ্ধের পরে) নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে অ-ইউরোপীয়ানদের বিশেষ করে প্রাচ্যকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে।২০২০সালে করোনা ভাইরাস যেনো ইউরোপ-আমেরিকানদের শ্রেষ্ঠত্বে বিরাট ধাক্কা দিলো।জ্ঞান-বিজ্ঞান,গবেষণা আর আভিজাত্যে শীর্ষে থাকা দেশগুলো রীতিমতো নাকানিচুবানি খাচ্ছে করোনার কাছে।বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ার আমেরিকাকে করোনায় সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় দেখেছে এই প্রজন্ম।প্রায় ২কোটির অধিক আমেরিকান এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে (প্রায় ২,০২,৩৭,৯৬৪ জন,ওয়াল্ডো মিটার, ৩১/১২/২০২০ইং হিসাব অনুযায়ি) এবং মৃত্যুর দিক দিয়েও আমেরিকানদের সংখ্যাটি সাড়ে ৩ লাখের অধিক (প্রায় ৩,৫১,১২৭ জন, ওয়াল্ডো মিটার, ৩১/১২/২০২০ইং হিসাব অনুযায়ি) যা কিনা এখন পর্যন্ত বিশ্ব রেকর্ড।একইভাবে করোনা ভাইরাসের নতুন রূপে নাজেহাল হয়ে রীতমতো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে এক সময়ের গোটা বিশ্বের আধিপত্য বিস্তারকারী ব্রিটিশরাও!২০২০ সালে বিশ্বের ধনীক রাষ্ট্রগুলোকেও কাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে আর কাকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় রাখবে সেই মানদন্ড ঠিক করতে হয়েছে।শুধু যে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল আর আক্রান্তের রেকর্ড হচ্ছে তা কিন্তু নয়,অর্থনীতি,পর্যটন,শিক্ষা,আমদানী-রপ্তানি ক্রিড়াতেও ধস নেমেছে এবং এর প্রভাব যে কতোদিন থাকবে সেটা কেউ হিসাব মেলাতে পারছেনা এখনো।এমন স্থবিরতা আমাদের প্রজন্ম দেখেনি কখনোই।একটি বিষয় বিস্ময়কর সেটা হলো প্রাচ্যে এখনো আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে কম!করোনার মতো এতো সংক্রামক রোগ এখনো বস্তি এলাকাগুলোতে মারাতœক আকার ধারণ করেনি।অথচ করোনা সংক্রমণ থেকে রেহাই পাননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও পরাক্রমশালী আমেরিকান প্রেসিডেস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও!
যেটা মনে হচ্ছে তা হলো,ইউরোপ-আমেররিকানদের আধিপত্যের মডেল ব্যর্থ হয়েছে।তাদের গবেষণা,চিকিৎসা আর প্রযুক্তি এখনো শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছায়নি বলে অনুমেয়।তাই সবাইকে যে তাদের অনুসরণ করতে হবে এবং সেটাই হওয়া উচিৎ সেট ধরণের মনোভাব পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে করোনা ভাইরাস।ইতিমধ্যে করোনার ভ্যাকসিন আসতে শুরু করেছে।ধনীক রাষ্ট্রগুলো আবারো নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসিতে লিপ্ত হয়ে গেছে।তাদের মোট জনসংখ্যার কয়েকগুণ বেশি ভ্যাকসিন মজুদের প্রতিযোগিতা করতে শুরু করেছে তারা।নিজেদের ছাড়া যেনো বাকিদের জীবনের কোন দাম নেই এখানে।আর করোনা যেনো এখনই ভ্যাকসিন কোম্পানির জন্য বিরাট বানিজ্য আইটেম বলে প্রকাশ পাচ্ছে।
নতুন বছরে কি আমরা একটি নিরাপদ ও সবার জন্য মানবিক বিশ্ব আশা করতে পারিনা?ধনীক রাষ্ট্রগুলো কি তাদের আধিপত্য ছেড়ে গোটা বিশ্বেকে নিয়ে শান্তির পথে হাঁটতে পারেনা? উন্নত,উন্নয়নশীল বা অনুন্নত ট্যাগ না দিয়ে আমরা কি এটা উপলব্ধি করতে পারিনা যে প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান?
লেখক: প্রভাষক,নৃবিজ্ঞান বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট।